ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

প্রণোদনা ও নীতির ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পারে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি

অভিমত

প্রণোদনা ও নীতির ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পারে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি

সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল

সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:৪৮ | আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১০:৫৪

অর্থনীতির দ্রুত বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে উদাহরণ তৈরি করতে পেরেছে। সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ভাষ্যমতে, ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের এ ধারা বজায় রাখতে এবং কৌশলগতভাবে আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ডিজিটাল অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করাটাও বিশেষ জরুরি। কারণ শতভাগ ডিজিটাল লেনদেনের বাস্তবায়ন ছাড়া পূর্ণতা পাবে না এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। ক্যাশলেস পেমেন্টকে ঘিরে ইতোমধ্যে সর্বত্রই আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। তবে প্রণোদনা ও সঠিক নীতিমালার অভাবে দেশে ডিজিটাল লেনদেন নিরুৎসাহিত হতে পারে।

ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হচ্ছে কার্ড ও এমএফএস সেবা। তবে অন্যান্য মাধ্যম হচ্ছে– পেমেন্ট টার্মিনাল, পিওএস (পয়েন্ট অব সেল) মেশিন, এটিএম, সিআরএম, এনএফসি (নিয়ার-ফিল্ড কমিউনিকেশন) প্রযুক্তি ইত্যাদি। গ্রাহকরা ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে তাদের ই-কমার্স পেমেন্ট, অন্যান্য বিল, অনলাইন ট্যাক্স রিটার্ন ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিশোধ করছেন।

ডিজিটাল লেনদেনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদাররা বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের  ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ’ রোডম্যাপের ভিত্তিতে ফুটপাতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে ছোট ও মাঝারি ব্যবসা সব কিছুকেই ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে যুক্ত করার কাজ চলছে। সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে বাংলা কিউআর কোডের প্রচলন ঘটিয়েছে এবং এই উদ্যোগে গ্রাহক ও ব্যবসায়ী সবাইকে উদ্বুদ্ধ করারও প্রচেষ্টা রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ট্যাপ অ্যান্ড গো’-কন্টাক্টলেস কার্ডের মাধ্যমে স্পর্শহীন লেনদেনের সুবিধা।  

এখন দেশে উৎসবের সময়। উৎসবকালে দেশে ডিজিটাল লেনদেনের বৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়। ঈদের মতো উৎসবের সময় তা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এবারের ঈদে তা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা মনে করি। রমজান ও ঈদকে ঘিরে বিভিন্ন অফার, ক্যাশব্যাক, রিওয়ার্ডস ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে গ্রাহকদের। মাস্টারকার্ডও এবার কার্ডহোল্ডারদের জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় অফার দিচ্ছে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে– ইফতারে বাই ওয়ান গেট থ্রি অফার, ডাইন-ইনে সর্বোচ্চ ২১ শতাংশ ডিসকাউন্ট, লাইফস্টাইল প্রোডাক্টসে ৫০ শতাংশ, ট্রাভেলে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত  ডিসকাউন্ট এবং দেশজুড়ে ৭ হাজারের বেশি মার্চেন্ট পার্টনারে বিভিন্ন অফার, যা দেশজুড়ে ডিজিটাল লেনদেন বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। এমনিতেই সাধারণত এমএফএস ও কার্ডের মাধ্যমে বর্তমানে মাসে সর্বোচ্চ ১.০৫ বিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের লেনদেন হচ্ছে।

ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে এমএফএস সেবা অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ড দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবহার হয়ে আসছে। লেনদেন এবং কেনাকাটায় বিশ্বজুড়ে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার প্রচলন খুব বেশি থাকলেও বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত কম। ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার নিয়ে জনমনে রয়েছে বিভিন্ন ভুল ধারণা। আমরা বিশ্বাস করি, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ‍বৃদ্ধি পেলে সাধারণ গ্রাহক ও ব্যাংক উভয়ই এতে লাভবান হবে।

২০১৯ সালে মাস্টারকার্ড, ওয়ালেট লোডিং/অ্যাড মানি সুবিধা নিয়ে আসার মাধ্যমে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং কার্ড নেটওয়ার্কের মধ্যে আন্তঃব্যবহারযোগ্যতার/ ইন্টারঅপেরাবিলিটি নিশ্চিত করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে আমরা ক্রেডিট কার্ড বিল পেমেন্ট এবং রেমিট্যান্স গ্রহণের মতো পরিষেবাগুলো সফলভাবে চালু করেছি। এমএফএস এবং কার্ড নেটওয়ার্ক উভয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টার জন্য এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।

তবে ক্রেডিট কার্ড গ্রহণের ক্ষেত্রে কর-সংক্রান্ত রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা বাজেটে অনুমোদিত হওয়ার বিষয়টি এই সেবা গ্রহণে ব্যবহারকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। এ ছাড়া পিওএস মেশিন, কার্ড-সংক্রান্ত উপকরণ ও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পণ্যের ওপর উচ্চ কর আরোপের ফলে ডিজিটাল লেনদেনের প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এখানে আরও উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনের সঙ্গে সংগতি রেখে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব লেনদেনের ৩০ শতাংশ এবং ২০৩১ সালের মধ্যে শতভাগ অনলাইন বা ক্যাশলেস লেনদেন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের অন্যতম স্তম্ভ ‘স্মার্ট ইকোনমি’ তৈরিতে ক্যাশলেস পেমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে সর্বস্তরে ক্যাশলেস পেমেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রণোদনা প্রদান করা জরুরি।

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ডিজিটাল খাতে ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন বলে  আমি মনে করি। যেখানে প্রণোদনার ৩ শতাংশ পাবেন ব্যবহারকারীরা এবং ২ শতাংশ যাবে মার্চেন্টদের কাছে। পাশাপাশি ডিজিটাল পেমেন্ট খাতে ভ্যাট এবং ট্যাক্স মওকুফ করাও জরুরি। প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশের এই  পথ অনুসরণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সর্বত্র ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি প্রণোদনা প্রদান, ক্যাশ লেনদেনকে নিরুৎসাহিত করা ও ডিজিটাল লেনদেনবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এখনই উপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়ব, নিরুৎসাহিত হবে ডিজিটাল অর্থনীতি ও টেকসই অর্থনীতির বিস্তার।
লেখক : কান্ট্রি ম্যানেজার, মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ

আরও পড়ুন

×