ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

করবহির্ভূত রাজস্ব আয় বাড়াতে বিশেষ নজর

করবহির্ভূত রাজস্ব আয় বাড়াতে বিশেষ নজর

সরকারি বিভিন্ন সেবার ফি ও মূল্য বাড়িয়ে করবহির্ভূত উৎস থেকে আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মেসবাহুল হক

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৪:৪৩ | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৪:৪৬

রাজস্ব আয় প্রত্যাশার চেয়ে কম হচ্ছে। তাই সরকারি বিভিন্ন সেবার ফি ও মূল্য বাড়িয়ে করবহির্ভূত উৎস থেকে আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গত তিন বছরে পরিবর্তন হয়নি, এমন সেবার মাশুল বাড়িয়ে নতুন করে নির্ধারণ করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদারের সভাপতিত্বে করবহির্ভূত রাজস্ব আদায় ও উদ্বৃত্ত অর্থ আদায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে– আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও শুল্ক। এ উৎসগুলো থেকে আয় সংগ্রহের দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। এর বাইরেও অন্যতম একটি খাত রয়েছে সরকারের রাজস্ব আয় সংগ্রহের, যেটাকে সরকার বলে করবহির্ভূত প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ)। সংক্ষেপে তা এনটিআর নামে পরিচিত।

সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে ইতোমধ্যে ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি আরও কাটছাঁটের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে সরকারি ব্যয় নির্বাহে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেওয়া হবে। নিজস্ব প্রয়োজন তো আছেই, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দিক থেকেও রাজস্ব আয় বাড়ানোর চাপ রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব সংগ্রহের হার ৮ শতাংশের কম। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি ইউএস ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলে দিয়েছে, বাংলাদেশকে রাজস্ব-জিডিপির হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরকার ঋণ দিলেও তার বিপরীতে সুদ পাওয়া যায় না। তাই গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাত থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আয় হয়েছে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা। সরকারি বিভিন্ন পরিষেবায় ৮ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ভাড়া ও ইজারায় ২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১ হাজার ৮০০, টোলে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিপরীতে ১ হাজার ২০০ কোটি এবং অবাণিজ্যিক বিক্রয় কার্যক্রম বাবদ ৪ হাজার কোটির বিপরীতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। তবে লভ্যাংশ, জরিমানা ও অন্যান্য রাজস্ব খাতে আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছু বেশি হয়েছে।

এনটিআর আদায় বাড়াতে ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে– এক বছরে ৩১টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর অংশগ্রহণে ৯টি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতায় ৭৭০টি এনটিআর আইটেমে রেইট হালনাগাদ করা হয়েছে। এ রাজস্ব আহরণে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগে বিভাগীয় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

এ ছাড়া সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রযোজ্য করবহির্ভূত রাজস্ববিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ তথ্যভান্ডার তৈরির কাজ চলমান। জেলা প্রশাসনসহ মাঠ প্রশাসনের দপ্তরগুলোর বিভিন্ন খাতে দীর্ঘদিন ধরে অব্যয়িত অবস্থায় থাকা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি এনটিআর রাজস্ব সংক্রান্ত গাইডলাইন প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে।

আদায় সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়, সরকারি পরিষেবাগুলোর মাশুল তিন বছর পরপর যৌক্তিক হারে বাড়িয়ে হালনাগাদ করতে হবে। সরকারি কোষাগারে অর্থ প্রদানে আবশ্যিকভাবে এ-চালানের ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আদায় করা রাজস্ব যথাসময়ে হিসাবভুক্ত করা হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। ইকুইটি গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের এজিএম বা বোর্ডসভায় সরকার কর্তৃক প্রদত্ত মূলধনের বিপরীতে লভ্যাংশ প্রদান নিশ্চিত করে অর্থ বিভাগকে জানাতে হবে। একই সঙ্গে বছর শেষে ব্যাংক হিসাবে অব্যয়িত অর্থ পড়ে থাকলে তা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে।

উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে করবহির্ভূত আয় সরকারি আয়ের একটি প্রধান উৎস। চীনের মোট রাজস্বের ৪০ শতাংশ হচ্ছে করবহির্ভূত আয়। মালয়েশিয়ায় যা ২৭ শতাংশ। এমনকি ছোট অর্থনীতির দেশ ভুটানে তা ২৮ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে এটি ১১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। অবশ্য বাংলাদেশেও কোনো কোনো সময় করবহির্ভূত রাজস্ব বেড়েছে। যেমন ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়েছিল মোবাইল অপারেটরদের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার স্পেকট্রাম বিক্রি এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে জমে থাকা বাড়তি তহবিল ফেরত নেওয়ায়। ওই দুই অর্থবছরে এনটিআর থেকে রাজস্ব আসে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা।

কিন্তু ওই দুই ধরনের আয় সব বছরেই হয় না। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় অন্য সব মন্ত্রণালয়কে ফি ও সেবামূল্য থেকে আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করার অনুরোধ করেছে। নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দাবি করেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। আবার দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে মানুষের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা গ্রহণের হার বেড়েছে। ফলে এনটিআর সংগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সক্ষমতা এবং সেবা প্রদানে উন্নতি না করতে পারলে শুধু দাম বাড়িয়ে কর ব্যতীত আয় তেমন বাড়বে না। সরকারি সেবার ফি ও চার্জ বাড়ানোর ফলে জনসাধারণের খরচই কেবল বাড়বে। ইতোমধ্যেই জমি ও গাড়ির নিবন্ধন বা পাসপোর্টের মতো সেবা নিতে বেশ অর্থ গুনতে হচ্ছে।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সমকালকে বলেন, সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কমই রয়ে গেছে করবহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব আয়। জাতীয় বাজেটে করবহির্ভূত এবং নন-এনবিআর উৎস থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা তুলনামূলক কম দেওয়া হয়। অথচ এসব খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক করে এখান থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণের সুযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে আয় বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি লভ্যাংশ পাওয়া গেলে এনবিআরের ওপর লক্ষ্যমাত্রা কমবে। এতে জনগণের ওপরও করের বোঝা কমার সুযোগ আসবে। এ বিষয়গুলোতে আরও নজর দিতে হবে।

জানা গেছে, এনটিআর থেকে ভালো রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়ে অর্থ বিভাগ কয়েক বছর ধরে কাজ করলেও ভালো ফল পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সংস্থাগুলোর যেমন অসহযোগিতা আছে, মন্ত্রণালয়গুলোও তেমন তৎপর নয়। মন্ত্রণালয়গুলো শুধু অর্থ নিতে চায়, অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে আগ্রহ কম।

সূত্রমতে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটে এনটিআর থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৪৯ হাজার কোটি টাকা করা হলেও প্রকৃত আয় হয় ৩৯ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয় ৩৮ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাত থেকে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

বিভিন্ন টোল ও মাশুল বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেছে অর্থ বিভাগ। দপ্তরগুলো হচ্ছে– বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), প্রধান আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিসিআইই), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি), নৌপরিবহন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর ইত্যাদি।

মাশুল বাড়াতে অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরগুলোকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জানানো হয়েছে, তারা যেন এনটিআর বাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে– বাণিজ্য, ভূমি, প্রাণিসম্পদ, রেলপথ, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ইত্যাদি। জানা গেছে, কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর এরই মধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো কোনো দপ্তরের মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এনটিআরের মধ্যে বড় ১০টি উৎস রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম লভ্যাংশ ও মুনাফা। ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের বিপরীতে সরকার লভ্যাংশ ও মুনাফা পায়। এ খাত থেকে চলতি অর্থবছর ৭ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছর যা ছিল ৮ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি বাজেটে সুদ বাবদ প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। সরকার, সরকারি কর্মচারী, বিভিন্ন আর্থিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদ পাওয়া যায়। প্রশাসনিক মাশুল বাবদ ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা।

আইন ও নিয়মনীতির পরিপন্থি বিভিন্ন কাজের জন্য সরকার জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ করে প্রতিবছর কিছু অর্থ আয় করে। সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে দেওয়া সেবার বিপরীতে আয় করে। যেমন আমদানি-রপ্তানি সনদের মাশুল, কোম্পানি নিবন্ধন মাশুল, বীমা প্রিমিয়াম, সমবায় সমিতিগুলোর নিরীক্ষা মাশুল, নিবন্ধন ও নবায়ন মাশুল ইত্যাদি। এসব সেবার বিপরীতে সরকার চলতি অর্থবছরে ৯ হাজার ১২৬ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

হাট-ঘাট ভাড়া ও ইজারা দিয়ে এ অর্থবছরে ৭২৬ কোটি টাকা এবং টোল ও লেভি থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আয় করতে চায়। সঙ্গে আছে মূলধন রাজস্ব। পুরোনো গাড়ি বা আসবাব নিলামে বিক্রির অর্থ মূলধন রাজস্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। এ খাতে আয় ধরা হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

×