যুক্তরাষ্ট্রের সুদহার কমানো এশিয়ায় যে বার্তা দিচ্ছে

ম্যাটিও লানজাফাম। ছবি: সংগৃহীত
ম্যাটিও লানজাফাম
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৪:৪৮
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের সাম্প্রতিক সুদের হার কমানোর পদক্ষেপ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য একই সঙ্গে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় এ অঞ্চলের নীতি নির্ধারকদের মূল্যস্ফীতির চাপ, বিনিময় হারে অস্থিরতা এবং পূঁজি আগমনের গতিশীলতা ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যপূর্ণ ও দেশভিত্তিক কৌশল নিতে হবে।
সেপ্টেম্বরের ওপেন মার্কেট কমিটির বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ বহু প্রতীক্ষিত মুদ্রানীতি শিথিল করার চক্র শুরু করেছে এবং সুদের হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়েছে। কমিটির সদস্যরা চলতি বছর আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট কাটছাঁটের পূর্বাভাস দিয়েছেন এবং এ শিথিলকরণ ২০২৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করছেন। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য।
চলতি বছর বছর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমেছে। কারণ পণ্যমূল্য স্থিতিশীল হয়েছে এবং গত বছরের আর্থিক কড়াকড়ির বিলম্বিত প্রভাব দেখা দিয়েছে। ফলে বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সুদের হার বৃদ্ধির চক্রে বিরতি দিয়েছে এবং কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার কমানোর দিকে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশও এখন একই পথ অনুসরণ করতে পারে।
নীতিগত অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে উদীয়মান অর্থনীতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুদের হার ব্যবধান বিবেচনায় নেওয়া জরুরি, যা পুঁজি প্রবাহ এবং বিনিময় হারের ওপর প্রভাব ফেলে। ফেডের সুদের হার কমানো এ অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য নীতি শিথিল করার সুযোগ তৈরি করেছে, যা পূঁজির বহিস্থ: প্রবাহ এবং বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন না ঘটিয়েই অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও প্রবৃদ্ধিকে উজ্জীবিত করতে পারে। তবে ফেডের শিথিলকরণ চক্রের গতি ও স্থায়িত্ব অনিশ্চিত থাকায় বিভিন্ন কারণে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপযুক্ত নীতি প্রতিক্রিয়ার জন্য সতর্ক এবং ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ফেডের পদক্ষেপ অনুসরণ করে সুদের হার কমাতে পারে, যা প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করবে। তবে এটি মূল্যস্ফীতি পুনরুজ্জীবিত করতে পারে এবং এমন অর্থনীতিতে অতিরিক্ত ঋণগ্রহণ উৎসাহিত করতে পারে, যেখানে গৃহস্থালি ও করপোরেট ঋণের স্তর ইতিমধ্যে উচ্চ পর্যায়ে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তুলনামূলকভাবে কঠোর আর্থিক নীতি বজায় রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ – ফেডের তুলনায় ধীরে বা কম হারে সুদের হার কমানো।
যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন সুদের হার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পুঁজি প্রবাহ বাড়াতে পারে। কারণ বিনিয়োগকারীরা অধিক আকর্ষণীয় মুনাফার সন্ধানে তাদের পোর্টফোলিও সামঞ্জস্য করবেন। এটি এ অঞ্চলের শেয়ার ও বন্ড বাজার চাঙ্গা করতে পারে এবং দুর্বল অর্থনীতিগুলোকে স্বস্তি দিতে পারে। তবে স্বল্পমেয়াদি পোর্টফোলিও বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য ওঠানামা আর্থিক বাজারের অস্থিরতা বাড়াতে পারে।
উচ্চ পুঁজি প্রবাহের ফলে মার্কিন ডলারের তুলনায় এ অঞ্চলের মুদ্রার মান বাড়তে পারে, যা তেল ও অন্যান্য পণ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির জন্য মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে বাণিজ্য ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারে। এছাড়া মার্কিন ডলারে ঋণ রয়েছে এমন অর্থনীতির জন্য ডলারের অবমূল্যায়ন ঋণের বোঝা বহন করা সহজতর করবে। তবে বিনিময় হারে স্থানীয় মুদ্রার মান বাড়লে আমদানিকে চাঙ্গা করতে পারে, যা চলতি হিসাবের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মধ্যমেয়াদে শক্তিশালী স্থানীয় মুদ্রা রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করতে পারে, বিশেষত পোশাক বা টেক্সটাইলের মতো ঐতিহ্যবাহী উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানির ক্ষেত্রে, যেগুলোর প্রতিযোগিতা মূলত মূল্যনির্ভর।
সম্ভাব্য প্রভাবের বহুমুখীতা ইঙ্গিত দেয় যে, ফেডের শিথিলকরণ চক্রের প্রতিক্রিয়ায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নীতি হতে হবে দেশভিত্তিক এবং সূক্ষ্ম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার সমন্বয়ের পাশাপাশি ব্যাংকের রিজার্ভ সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়তার মতো লক্ষ্যনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারে। এবং ফরওয়ার্ড গাইডেন্স বা অগ্রিম নির্দেশনা ব্যবহার করে আর্থিক ও তারল্য পরিস্থিতি প্রভাবিত করতে পারে। ফরওয়ার্ড গাইডেন্স অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আর্থিক অস্থিতিশীলতা কমাতে একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। কারণ এটি বাজারের অংশগ্রহণকারী এবং অর্থনৈতিক এজেন্টদের জন্য মুদ্রানীতির ভবিষ্যত পথ পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করে, যা মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশাগুলোকে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করে।
যেসব অর্থনীতিতে মূলধন প্রবাহ বাড়ছে, তাদের জন্য উন্নত আর্থিক বাজার এসব মূলধন দেশীয় অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে রূপান্তর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নীতিগত পদক্ষেপগুলোর লক্ষ্য হওয়া উচিত আর্থিক খাতে প্রতিযোগিতা, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা বাড়ানো। মূলধন প্রবাহের ঝুঁকি মোকাবেলায় এবং মুদ্রার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে লক্ষ্যনির্দিষ্ট হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে এবং পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো যেতে পারে। রাজস্ব নীতির মাধ্যমে রপ্তানি কমার প্রভাব মোকাবিলা করা যেতে পারে। রাজস্ব নীতির মাধ্যমে উদ্দীপনা বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালিত হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ভোক্তা ব্যয় বাড়ানো, যেসব খাতে প্রবৃদ্ধির প্রভাব বেশি সেসব খাতে কার্যক্রম উৎসাহিত করা এবং অবকাঠামো, জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রকল্প, জলবায়ু অভিযোজন এবং অন্যান্য প্রকল্প অর্থনীতির উৎপাদনশীল সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলবে।
যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমা এবং দুর্বল ডলারের ফলে আমদানি ব্যয় কমা আর্থিক বাজারের উন্নতি, এবং এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিকে আরও বড় মূলধন প্রবাহ উৎসাহিত হতে পারে। তবে ইতিবাচক উন্নয়নগুলোর পাশাপাশি কিছু ঝুঁকি রয়েছে, যেমন –বিনিময় হারের অস্থিরতা এবং মূল্যস্ফীতির চাপ পুনরায় বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা। এ কারণে নীতিনির্ধারকদের নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, যাতে তারা সুযোগগুলো কাজে লাগাতে এবং ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করতে সতর্ক ও সক্রিয় থাকতে পারেন।
লেখক: প্রধান অর্থনীতিবিদ, মাইক্রোইকনোমিক্স রিসার্চ ডিভিশন, এডিবি
এডিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ব্লগ থেকে অনুদিত।
- বিষয় :
- যুক্তরাষ্ট্র
- সুদহার
- এশিয়া