টেকসই অর্থায়নে উচ্চ প্রবৃদ্ধি

.
জাকির হোসেন
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:১৬ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৪ | ১২:৪১
ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টেকসই অর্থায়ন প্রতিবছর বাড়ছে। চলতি বছর পরিবেশবান্ধব এ অর্থায়ন বৃদ্ধির হার আগের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালানাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে মোট টেকসই অর্থায়নের পরিমাণ ২ লাখ ৫ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে যা ২৮০ শতাংশ বেশি। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়কালে এ ধরনের অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ৭৩ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রিন ফিন্যান্স বা সবুজ অর্থায়ন এবং সাসটেইনিবিলিটি লিঙ্কড বা টেকসই সংযুক্ত অর্থায়ন মিলিয়ে মোট সাসটেইনেবল ফিন্যান্স বা টেকসই অর্থায়নের হিসাব করে। সম্প্রতি এ বিষয়ে গত এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ওই প্রান্তিকে টেকসই অর্থায়ন হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার, যা আগের প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) প্রান্তিকের চেয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।
২০২৩ সালে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকার টেকসই অর্থায়ন করে, যা তাদের মোট ঋণের ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি বছরের ছয় মাসে এ হার দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশ। ২০২২ সালে টেকসই অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
টেকসই অর্থায়ন কী
পরিবেশ, সামাজিক ও সুশাসন বিবেচনার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব কিনা, তা নির্ধারণ এবং ভবিষ্যতে সমাজের সব স্তরের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা, এমন অর্থায়নকে টেকসই অর্থায়ন হিসেবে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক নিয়ম ও মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই অর্থায়নকে আরও বিস্তৃতভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই অর্থায়ন নীতি অনুযায়ী এটি মূলত যে কোনো ধরনের আর্থিক পরিষেবা বোঝায়, যার মধ্যে বিনিয়োগ, বীমা, ব্যাংকিং, অ্যাকাউন্টিং, ট্রেডিং এবং আর্থিক পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত এবং যা গ্রাহক এবং সমাজ উভয়ের দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা বিবেচনা করে এবং ব্যবসা বা বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে পরিবেশগত, সামাজিক এবং পরিচালন মানদণ্ড একীভূত করে। পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন, টেকসই কৃষি, টেকসই সিএমএসএমই এবং সামাজিক দায়বদ্ধ আর্থিক কার্যক্রম নিয়ে টেকসই অর্থায়ন গঠিত।
টেকসই অর্থায়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশ ভৌগোলিক কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকিগ্রস্ত দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আর্থিক খাতের অনেক বড় দায়িত্ব রয়েছে। সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নীতি-সহায়তা এবং পরিবেশের প্রতি নিজস্ব দায়বদ্ধতা থেকে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গত কয়েক বছরে এ ধরনের অর্থায়নে অধিকতর মনোযোগী হয়েছে। অর্থনীতিতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন চর্চা উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশে শিল্প প্রকল্প অর্থায়নের প্রধান উৎস ব্যাংক এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বস্ত্র, জ্বালানি, সার, সিমেন্ট, ইস্পাত, কাগজসহ বিভিন্ন শিল্পে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রচুর কার্বন নিঃসরণ হয়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-সহায়তায় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে উৎসাহিত করতে সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা অর্থায়নের শর্ত হিসেবে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে এবং ধারাবাহিকভাবে এই ধরনের তৎপরতা বাড়াচ্ছে। তারা পরিবেশগতভাবে টেকসই এবং সামাজিকভাবে যৌক্তিক বিনিয়োগে গ্রাহকদের উৎসাহিত করছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। তৈরি পোশাক খাতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সবুজ কারখানার বেশির ভাগই বাংলাদেশে। টেকসই অর্থায়ন সামগ্রিকভাবে কার্বন নিঃসরণ কমাতে সহায়তা করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সময় থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ব্যাংক এবং আর্থিক খাতের ভূমিকা নিয়ে বহুলভাবে আলোচনা শুরু হয়। পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আর্থিক খাত ঋণ এবং মূলধন সরবরাহ করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এর আলোকে পরিবেশ দূষণ রোধে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতের জন্য বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। বর্তমান বৈশ্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় টিকে থাকতে ব্যাংকগুলো নিজের স্বার্থেই পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করছে। কোনো কারখানা যদি পরিবেশ এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন সূচকে নির্ধারিত মাত্রা পরিপালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে উৎপাদিত পণ্য বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা খুবই কঠিন। ফলে ওই কারখানায় ব্যাংকের ঋণ প্রদান ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। এসব কারণে পরিবেশবান্ধব কারখানা রূপান্তরে টেকসই এবং সবুজ অর্থায়ন প্রয়োজন, যা ব্যাংকের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করছে। ফলে বর্জ্য পানি পরিশোধনাগার (ইটিপি), নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র, জ্বালানি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সাশ্রয়ী প্রকল্প, সবুজ কারখানা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, হাইব্রিড বা বৈদ্যুতিক গাড়ি, সবুজ ভবন, সবুজ কারখানা ইত্যাদি খাতে টেকসই অর্থায়নের সুযোগ বাড়ছে।
টেকসই অর্থায়নে কারা এগিয়ে
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা হলো– মোট ঋণ বিতরণের কমপক্ষে ২০ শতাংশ টেকসই অর্থায়ন হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৪টি ব্যাংক টেকসই অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রগতির বিবেচনায় এসব ব্যাংক হলো– ব্র্যাক, ইস্টার্ন, যমুনা, সিটি, এক্সিম, প্রাইম, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, প্রিমিয়ার, ইউসিবিএল, ন্যাশনাল, এনআরবি, ব্যাংক এশিয়া, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, কৃষি, ট্রাস্ট, উত্তরা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, বেসিক, ডাচ্-বাংলা, স্ট্যান্ডার্ড, এনসিসি, এইচএসবিসি, সোশ্যাল ইসলামী এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক।
অন্যদিকে ১৩টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের মোট ঋণের ২০ শতাংশের বেশি টেকসই অর্থায়ন করেছে। অগ্রগতির বিবেচনায় ক্রমানুসারে এসব প্রতিষ্ঠান হলো– অ্যালায়েন্স ফিন্যান্স, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপেমন্ট, ইউনাইটেড ফিন্যান্স আইপিডিসি, সিভিসি ফিন্যান্স, বাংলাদেশ ফিন্যান্স, বিআইএফএফএল, ন্যাশনাল ফিন্যান্স, সাবিনকো, আইডিএলসি, অগ্রণী এসএমই ফিন্যান্সিং, ইউএই বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট, ফিন্যান্স এবং লংকাবাংলা।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ
ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ‘সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ইউনিট’ গঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টেকসই অর্থায়ন নীতি জারি করে। এর আলোকে প্রতিটি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব নীতি প্রণয়ন করেছে। তারা গ্রাহকদের উৎপাদন চর্চায় পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অনুসরণ করছে। অর্থায়নের শর্তের সঙ্গে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয় যুক্ত করছে। গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ প্রদানের মানদণ্ড অনুসরণে পরিবেশ এবং সামাজিক ঝুঁকি পরিপালন নিশ্চিত করছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ ও সামাজিক মূল্যায়ন করছে, যাতে উৎপাদন বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে পরিবেশ দূষণ না হয়। বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি), নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র, জ্বালানি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সাশ্রয়ী প্রকল্প, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, হাইব্রিড বা বৈদ্যুতিক গাড়ি, সবুজ ভবন, সবুজ কারখানা ইত্যাদি খাতে তারা অর্থায়ন বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যা করেছে
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১১ সালে পরিবেশগত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার গাইডলাইন জারি করে। এ ছাড়া গ্রিন ব্যাংকিং পলিসি গাইডলাইন জারি করে। ২০১৪ সালে সবুজ অর্থায়নের ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়। ২০১৬ সালে জলবায়ু ঝুঁকি তহবিল গঠনের নির্দেশনা দেয়। একই বছর ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করে। রপ্তানিমুখী বস্ত্র এবং চামড়া শিল্পের জন্য ‘গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড’ চালু করে। সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ইউনিট স্থাপন এবং সাসটেইনেবল ফিন্যান্স কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রিন ফিন্যান্সের জন্য পণ্য এবং উদ্যোগের বিস্তৃত তালিকা প্রকাশ করে। ২০১৮ সালে ইসলামিক পুনঃঅর্থায়নের জন্য মাস্টার সার্কুলার জারি করে। ২০২০ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সাসটেইনিবিলিটি রেটিং চালু করে। ২০২৩ সালে সাসটেইনেবল ফিন্যান্স নীতির সার্কুলার জারি করে। একই বছরে সাসটেইনেবল ফিন্যান্সের রিপোর্টিং ফরম্যাট চালু করে। একই বছরে সাসটেইনিবিলিটি এবং পরিবেশ বিষয়ে আর্থিক ঘোষণার গাইডলাইন জারি করে।
টেকসই অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পুনঃঅর্থায়ন স্কিম রয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংক স্বল্প সুদে তহবিল পাচ্ছে এবং গ্রাহকরাও তুলনামূলক কম সুদে ঋণ পাচ্ছে। সুদের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকায় গ্রাহকদের কাছে স্বল্প সুদের অর্থায়ন বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তারা ক্রমাগত পরিবেশবান্ধব অর্থায়নের দিকে ঝুঁকছেন। ২০২০ সালে মার্কিন ডলারে ২০০ মিলিয়ন এবং ইউরোতে ২০০ মিলিয়নের গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডের (জিটিএফ) মাধ্যমে পুনঃঅর্থায়ন চালু করে। ২০২১ সালে রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালু করে। ২০২২ সালে পরিবেশবান্ধব পণ্য, প্রকল্প এবং উদ্যোগের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিম প্রণয়ন করে।
- বিষয় :
- অর্থ সহায়তা