ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাতের আসল চিত্র সামনে আনার চেষ্টা

ফাইল ছবি
ওবায়দুল্লাহ রনি
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৪
বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-জালিয়াতি নিয়ে আলোচনা ছিল। তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় জালিয়াতির চিত্র আড়াল করার জোর চেষ্টা ছিল। ভেতরে ভেতরে ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাতে এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। ব্যাংকিং খাত সংস্কারে একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, ঋণের আসল সুবিধাভোগী কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি খোঁজা হচ্ছে। বড় গ্রুপগুলো ঋণের টাকায় কোথায় কী সম্পদ করেছে, তা উদ্ধার করে আমানতকারীর পাওনা পরিশোধের চেষ্টা রয়েছে। অর্থ পাচারে লাগাম টানারও জোর চেষ্টা রয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ব্যাংকিং খাত সংস্কারে এমন কঠোরতা দেখা যাচ্ছে। সংস্কার করতে গিয়ে যেসব সংকট সামনে আসছে, সেগুলো মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ রয়েছে সরকারের সামনে। এতদিন বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ বিনা বাধায় নানা সুবিধা পেয়ে আসছিল। এখন তাদের অনিয়ম-জালিয়াতি ধরা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দখল করা ব্যাংকে নিয়ম ফেরানোর চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বা সরকারের নীতিনির্ধারকদের সর্বোচ্চ উদ্যোগ রয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর একটি অংশের মধ্যে তার বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। আবার ব্যাংকগুলোতে এখনও আগের এমডি বহাল থাকা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি রোধে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোটামুটি সোচ্চার ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবস্থা নিতে না পারলেও বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ, পদ্মা ব্যাংকের অনিয়ম-জালিয়াতি সামনে আনা হয়েছে। ২০১৬ সালের রিজার্ভ চুরির তথ্য ফাঁসকে কেন্দ্র করে পদ হারান তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এরপর সাবেক সচিব ফজলে কবির গভর্নরের দায়িত্বে আসার পর নীতিমালা করে জালিয়াতির সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। তাঁর প্রতি খুশি হয়ে গভর্নরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়। তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০২২ সালে গভর্নর হন আরেক আমলা আব্দুর রউফ তালুকদার। আগের ধারাবাহিকতায় তিনিও অনিয়ম-জালিয়াতিতে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ বিস্তর। এমনকি জালিয়াতি বন্ধের উদ্যোগ না নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ বন্ধেও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন তিনি। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ব্যাপক সমালোচিত হন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ড. আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি দায়িত্বে আসার পর মালিকানায় যুক্ত থেকে জালিয়াতি হচ্ছিল এমন ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে– কোনো তথ্যে আর লুকোচুরি চলবে না। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ব্যাংকিং খাত সংস্কার, জালিয়াতিতে সম্পৃক্তদের থেকে অর্থ উদ্ধার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কারের। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফিরিয়ে আনা হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের সব নিয়ম-নীতিতে আন্তর্জাতিক মান। পাচার রোধে কঠোরতার সুফলও মিলতে শুরু করেছে। রপ্তানি আয়ে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্সে ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থিতিশীলতা ফিরেছে। গত নভেম্বরে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসা রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন হয়েছে। বিগত সরকারের শেষ সময়ে প্রতি মাসে গড়ে যেখানে রিজার্ভ কমছিল ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার করে।
বিগত সরকার অনিয়ম-জালিয়াতির বিরুদ্ধে কঠোরতার পরিবর্তে সহায়ক ছিল। বিভিন্ন সমালোচনা থাকলেও বিগত সরকার ব্যবসায়ীদের নানা ক্ষেত্রে সুবিধা দিয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি নির্বাচনের আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধন করে পরিবারের প্রভাব বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী, একটি গ্রুপের এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও আরেক প্রতিষ্ঠান খেলাপি বিবেচিত হচ্ছে না। এক পরিবার থেকে তিনজন এবং আরও দু’জন প্রতিনিধি পরিচালক থাকার সুযোগ রয়েছে। এসব আইনও আন্তর্জাতিক মানের করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মোটাদাগে অনিয়ম-জালিয়াতি রোধে কঠোর হয়েছে। ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে ব্যাংক ঋণে ৯ শতাংশ সুদের সীমা আরোপ করা হয়েছিল। ডলারের দর কৃত্রিমভাবে ৮০ থেকে ৮৪ টাকায় আটকে রাখা হয়। তবে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা আর আটকে রাখা যায়নি। ডলারের দর বেড়ে ১২৫-১২৬ টাকায় উঠেছে। আবার সুদহার গিয়ে ঠেকেছে ১৬ শতাংশে।
নিয়ম শিথিল করে বিগত সরকারের সময়ে ঋণ পুনঃতপশিল, পুনর্গঠন কিংবা টাকা না দিয়েও ঋণ নিয়মিত দেখানোর মতো সুযোগ দেওয়া হয়। সরকার পরিবর্তনের পর লুকানো খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে আসতে শুরু করেছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা প্রায় ১৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ। এ বছরের প্রথম ৯ মাসেই খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অবশ্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির মতে, ব্যাংকিং খাতে খারাপ ঋণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। নানা শিথিলতা ছাড়াও ২০১৯ সালে অদ্ভুত এক নীতিমালা করা হয়। সে অনুযায়ী ৬ মাস কিস্তি না দিলেও মেয়াদোত্তীর্ণ বিবেচনা করা হতো না। আগামী মার্চ থেকে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিনই মেয়াদোত্তীর্ণ বিবেচিত হবে। আবার নির্দিষ্ট কিছু আইনজীবীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের কয়েকটি বেঞ্চে রিট করলেই খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোর নির্দেশনা এখন কমেছে।
- বিষয় :
- ব্যাংকিং ব্যবস্থা