মুক্তচিন্তার অধিকার

আবুল কাসেম ফজলুল হক
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ | ২০:৪০
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও তার সংস্কার নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। বহু সাংবাদিক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকসহ আরও কোনো কোনো অবস্থানের অনেকে এই আইনের আওতায় অভিযুক্ত হয়ে মামলায় পড়েছেন, আদালতের আদেশে কারাভোগ করেছেন এবং নানাভাবে হয়রান হয়েছেন, হচ্ছেন। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টকেও মানবাধিকারবিরোধী বলা হচ্ছে। সমাজের সচেতন ও প্রগতিশীল মহলের একটি অংশ থেকে ক্রমাগত এসব আইন বাতিল করার দাবি তোলা হয়েছে এবং সরকারপক্ষ থেকে এসব আইনের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে ক্রমাগত মত ব্যক্ত করা হচ্ছে। আইনের যে সংস্কার সামনে এসেছে, সেটিকেও বাতিল করার দাবি তোলা হচ্ছে। আমার ধারণা, ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দলের স্বার্থে এসব আইনকে কাজে লাগানো হচ্ছে। ফলে মানবাধিকার বা আইনের শাসন ব্যাহত হচ্ছে। এসব আইন বাতিল করে মানবাধিকার বা আইনের শাসন নিশ্চিত করা দরকার। দেশব্যাপী বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে যেভাবে হয়রান করা হচ্ছে, তাও বন্ধ করা উচিত।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার জন্যও এটা দরকার। সরকার থেকে বিএনপিকে রাজাকারের দল, পাকিস্তানপন্থি দল, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ইত্যাদি বলা হচ্ছে। এসবের প্রমাণ যদি সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতাদের জানা থাকে, তাহলে সে সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএপিকে নিষিদ্ধ করা উচিত। তা না করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি ও বিপক্ষ শক্তি বলে জনসাধারণকে যে বিভক্ত করা হয়েছে, তা জাতীয় ঐক্যের ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য জাতীয় ঐক্য একান্ত দরকার। জাতীয় অনৈক্যের জন্য কেবল বিএনপিকে দায়ী করে সরকার ও সরকারি দল প্রচার চালায়, তাতে জাতীয় শক্তির চেয়ে জাতীয় দুর্বলতা অনেক বড় হয়ে সামনে আসে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি কি সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করতে পারছে? বাংলাদেশে জাতীয় অনৈক্যের জন্য কেবল বিএনপি দায়ী– তা নয়; বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগও অবশ্যই দায়ী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যেভাবে বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের একান্ত অভ্যন্তরীণ ব্যাপারাদিতে হস্তক্ষেপ করে চলছে, তা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য এবং দুর্বলতার কারণে। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসন ব্যবস্থাকে যেভাবে সাজানো হয়েছে, তা দিয়ে কোনো নির্বাচন সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ কি জাতীয় ঐক্য চায়? বিএনপি কী চায়? বাংলাদেশ কোন পথে চালিত হচ্ছে? বাংলাদেশে মানবাধিকার বা আইনের শাসন অর্জন করার এবং রক্ষা করার সমস্যা নতুন নয়। সমস্যার প্রকৃতিও সব সময় একরকম ছিল না– ভবিষ্যতেও এ রকম থাকবে না। এ নিয়ে সব সময়ই আলোচনার ও কাজ করার প্রয়োজন আছে এবং থাকবে। ১৯৭২ সাল থেকে আওয়ামী লীগ জনসাধারণকে কেবল নিজের সমর্থনে টানার চেষ্টা করে চলছে; রাজনীতিতে কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব রাখতে চায়নি। আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রয়োজনীয় জাতীয় ঐক্যের বিবেচনা বাদ দিয়ে চলছে। ফলে আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে।
অপারেশন ক্লিনহার্ট, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ দিয়ে কী সুফল হয়েছে? রাজনীতিতে ইসলামের ব্যবহার দ্বারা কী সুফল হচ্ছে? বছরখানেক ধরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে নির্দ্বিধায় অনধিকার হস্তক্ষেপ চালাচ্ছে। এই অবস্থাটা তৈরি হয়েছে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরখানেক পর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে ভূমিকা পালন করেছে তার ফলে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিকে করে তুলেছিল পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের ঢাকাস্থ দূতাবাসসমূহের অভিমুখী। বাস্তবে দেখা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা, কথিত বিশিষ্ট নাগরিকেরা ও সাংবাদিকেরা নিকট অতীতের ঘটনাবলিকেও সম্পূর্ণ ভুলে যান। সেনাপতি এরশাদের শাসনকাল থেকে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ প্রধানত আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে নিয়ে বাংলাদেশে নিঃরাজনীতিকরণের যে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, তার কথা রাজনীতিবিদেরা, কথিত বিশিষ্ট নাগরিকেরা ও সাংবাদিকেরা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছেন।বাংলাদেশের রাজনীতি যে দুর্গতিতে পড়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য পাঁচ বছর পরপর কোনোক্রমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে সরকার গঠন করতে পারলেই হলো– এটা হলো রাজনীতিবিদদের, কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের এবং সাংবাদিকদের মনোভাব। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম চিন্তাও আছে; তবে সমর্থনের অভাবে তা দুর্বল, সবল হচ্ছে না। রাজনীতিতে নতুন ধারা গড়ে তোলার অনুকূল কোনো প্রচারমাধ্যম নেই। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিন্তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে কূটকৌশলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার উপায়ের মধ্যে। নির্বাচনকেই বলা হচ্ছে গণতন্ত্র! পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ অত্যন্ত আনন্দিত যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ একেবারে কমে গেছে। এ অবস্থায় তারা গণতন্ত্রকে তাদের ধনবাদী ও আধিপত্যবাদী কর্তৃত্বের পথে বড় বাধারূপে দেখেছে এবং গণতন্ত্রের ধারণাকে কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে।
কথিত এই গণতন্ত্রের প্রতি দুনিয়াব্যাপী মানুষের আগ্রহ নিঃশেষ হয়ে গেছে। অন্তত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি চিন্তা কেবল নির্বাচন করার উপায়ের চিন্তায় সীমাবদ্ধ। হত্যা-আত্মহত্যা, ধর্ষণ, নারীহত্যা ও নারী নির্যাতন, ঘুষ, মুক্তিপণ, প্রতারণা, দ্রব্যমূল্য, বিদেশে অর্থ পাচার ইত্যাদি কর্মকাণ্ড প্রায় অবাধে চলছে। এই বাস্তবতায় কেবল মানবাধিকার, আইনের শাসন, অপরাধীদের শাস্তিদান ইত্যাদির দ্বারা সুফল পাওয়া যাবে না। গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ও কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা অপরিহার্য। আর্থসামাজিক রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রেখে কেবল সামাজিক পরিবর্তন ঘটালে তা স্থায়ী হয় না এবং কার্যকরও হয় না। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা দুই ক্ষেত্রেই মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। জাতিসংঘের পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের কায়েমি-স্বার্থবাদী ভূমিকার কারণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আলোচনা করতে হলে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে হবে।
বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আগে নিয়ন্ত্রণ করত সরকার। সরকার নিয়ন্ত্রণ করত আইন জারি করে। সরকারের বাইরে অন্য নিয়ন্ত্রককে তখন গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো না। গত চার দশকের মধ্যে সরকারি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নানা নিয়ন্ত্রণ বড় হয়ে উঠেছে। বাস্তবে দেখা যায়, সামরিক শাসন ও জরুরি অবস্থার মধ্যেও অধিকাংশ সময় মতপ্রকাশের সুযোগ থাকে। আমরা সর্বজনীন কল্যাণের পরিপন্থি নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি, সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ নয়। প্রচারমাধ্যম এখন সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রক। রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, অসহিষ্ণু ধর্মীয় শক্তি, শিক্ষাব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি এখন সরকারের চেয়েও বড় নিয়ন্ত্রক। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এখন অদৃশ্য। কিন্তু সমাজের স্তরে স্তরে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আছে কঠোর মত নিয়ন্ত্রক। নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এখন দেশি-বিদেশি নানা অপশক্তির হাতে।
সকলেই চিন্তক নন, কেউ কেউ চিন্তক; সকলেই ভাবুক নন, কেউ কেউ ভাবুক। নতুন চিন্তা, নতুন ভাব ও নতুন মত প্রকাশ করার তাগিদ চিন্তক এবং ভাবুকেরাই অনুভব করেন। চিন্তার স্বাধীনতা তাদের জন্যই দরকার। তাদের থেকেই আত্মপ্রকাশ করেন আবিষ্কারক, উদ্ভাবক ও স্রষ্টা। তারা প্রতিভাবান, তারা প্রগতিশীল, তারা দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, জ্ঞানসাধক, আদর্শবাদী, স্বাপ্নিক। উন্নততর নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন তারা দেখেন এবং সকলকে দেখান। চিন্তক ও ভাবুকদের চিন্তা ও কাজের দ্বারা সকলেই লাভবান হন। কায়েমি স্বার্থবাদী ও হীন স্বার্থান্বেষীরা তাদের কাজকে ভয় পায়। মনে করে, সৃষ্টিশীল ও প্রগতিশীলদের চিন্তা তাদের ক্ষমতা ও সম্পত্তির জন্য ক্ষতিকারক হবে। এ জন্য সর্বশক্তি দিয়ে তারা সৃষ্টিশীল ও প্রগতিশীলদের নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের চিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করে– তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। ইতিহাসে এর দৃষ্টান্তের অভাব নেই। নির্যাতন ও দমন নীতিকে অতিক্রম করে কিংবা মোকাবিলা করেই সৃষ্টি ভাস্বর হয়েছে। স্বার্থের ব্যাপার আছে। অকারণে কেউ কারও চিন্তার স্বাধীনতায় বাধা দেয় না। প্রতিভাবান ও সৃষ্টিশীলেরাও সব সময় অভ্রান্ত হন না। ভুলত্রুটি সংশোধন ও প্রগতির জন্য আলোচনা-সমালোচনা অপরিহার্য। সমালোচনার সকল পক্ষের মধ্যেই সত্যসন্ধানী ও সত্যনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল শক্তি সমাজে থাকবেই। তাদের মধ্যে দরকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি। প্রতিযোগিতা থাকবে কিন্তু তা হবে সহিংসামুক্ত, জবরদস্তিমুক্ত ও সম্মানজনক। প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
স্বার্থের বেলায় ন্যায়স্বার্থকে হীনস্বার্থ থেকে আলাদা করে দেখতে হবে। নিজের হোক অন্যের হোক ন্যায়স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আর হীনস্বার্থকে প্রতিহত করতে হবে। এ জন্য প্রগতিশীলদের ক্রমাগত সংগ্রাম করতে হবে। বাংলাদেশে সর্বজনীন কল্যাণে চিন্তার চর্চা দরকার। সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞানের চর্চা দারকার। সকলেরই কর্তব্য বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি পেলে বর্তমানের অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। রাজনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনীতিবিদদের শ্রদ্ধালাভের যোগ্য হতে হবে। সক্রেটিসের একটি উক্তি মনে পড়ছে– Life is unexamined is not worth living.
লেখক চিন্তাবিদ প্রাক্তন অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়