ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

উচ্ছিষ্টে সম্ভাবনা: ময়লার পাহাড়ে টিকে থাকার লড়াই!

উচ্ছিষ্টে সম্ভাবনা: ময়লার পাহাড়ে টিকে থাকার লড়াই!

রবিন দাশ গুপ্ত

রবিন দাশ গুপ্ত

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | ১৭:০০ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ | ১৭:১৮

চট্টগ্রাম নগরীর একটি বর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্রে সড়কের পাশেই ছড়িয়ে আছে ঘরোয়া ও বাণিজ্যিক উৎস থেকে আসা ময়লার স্তূপ। দূর থেকেই চোখে পড়ে হলুদ হেলমেট, গ্লাভস ও সেফটি বুট পরা একদল কর্মী– যাদের গায়ে উজ্জ্বল কমলা রঙের ইউনিফর্ম। সেই দলেরই একজন সালমা খাতুন (৫৫)। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) স্বল্প বেতনের চাকরির পাশাপাশি আয় বাড়াতে তিনি খুঁজে পেয়েছেন বিকল্প একটি পথ।

সম্প্রতি নগরীর আমবাগান এলাকায় দেখা মেলে তাঁর। সালমা জানান, চসিক, ইউনিলিভার বাংলাদেশ এবং বেসরকারি সংস্থা ইপসার যৌথ প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি প্রতিমাসে প্রায় ২০০ কেজি পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন। সেগুলো বিক্রি করে মাসে আয় করেন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।

তাঁর ভাষায়, ‘আগে শুধু করপোরেশনে কাজ করতাম। অল্প কিছু প্লাস্টিক কুড়িয়ে বিক্রি করতাম। দেড়-দুই বছর আগে ইপসার কয়েকজনের কাছ থেকে জানতে পারি, পলিথিনও বিক্রি হয়। তখন থেকেই আয় বেড়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কাজের নিয়ম– সব শেখানো হয়। গত বছর সিটি করপোরেশনের মেয়রের হাত থেকে সেরা কর্মীর পুরস্কারও পেয়েছি।’

সন্তানদের কথা বলতে গিয়ে সালমা বলেন, ‘দুই ছেলে পড়াশোনা করে। আগে টিফিনের টাকাটাও দিতে পারতাম না, এখন নিয়মিত দিতে পারি। জানি, প্লাস্টিক ও পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই এটা তুলে দিয়ে পরিবেশের জন্য কিছু করতে পারছি– তা ভাবলেই শান্তি পাই। এখন শুধু পরিচ্ছন্নতাকর্মী না, আমাকে সবাই পরিবেশকর্মীও বলে।’

এই উদ্যোগের আওতায় তিন হাজারের বেশি বর্জ্য সংগ্রাহক এবং প্রায় ২০০ ভাঙারিওয়ালা নিয়মিত কাজ করেন।
নগরের অভয় মিত্র ঘাটের পাশে কর্ণফুলী নদীর তীরে ভাঙারির ব্যবসা করেন মো. সালাউদ্দিন। তাঁর ভাষায়, ‘বাসাবাড়ির ময়লার বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে নদীতে চলে আসে। প্লাস্টিক তুললেও পলিথিন থাকতই। দেড় বছর আগে ইউনিলিভার আর ইপসা আমাদের জানায়, পলিথিনও বিক্রি হয় এবং তারা এর আলাদা মূল্যও দেয়। আমার তত্ত্বাবধানে এখন ২০ জন সংগ্রাহক কাজ করেন। সবাই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও পাচ্ছেন।’

গবেষণা বলছে, চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য প্রায় ২৪৯ টন। এর মধ্যে সামান্য অংশই পুনর্ব্যবহারযোগ্য। কারণ হালকা ও অপরিষ্কার পলিথিনের বাজারমূল্য কম হওয়ায় সংগ্রাহকরা সাধারণত এগুলো তুলতে আগ্রহী হন না। একজন সংগ্রাহকের পক্ষে প্রতিদিন তিন-চার কেজির বেশি পলিথিন সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।

এই উদ্যোগের আওতায় এখন পর্যন্ত ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে– যা নগরের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ১০ শতাংশ। প্রায় পাঁচ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী, সংগ্রাহক ও ভাঙারিওয়ালাকে প্রশিক্ষণ, সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং স্বাস্থ্য বীমার সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে।

বর্তমানে চট্টগ্রামে তিন শতাধিক রিসাইক্লিং সদস্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। যেহেতু শহরের বেশির ভাগ বর্জ্যের উৎস বাসাবাড়ি, তাই এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার পরিবার এবং সাত হাজার স্কুলশিক্ষার্থীর মাঝে বর্জ্য পৃথকীকরণ ও পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।

এই উদ্যোগের আশাব্যঞ্জক দিক হলো, প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে একটি বিকল্প অর্থনৈতিক পথ। ইউনিলিভার ও তাদের অংশীদারদের এ উদ্যোগ শুধু পরিবেশ রক্ষা করছে না; বরং কর্মসংস্থান, সচেতনতা এবং টেকসই জীবিকার ভিত্তিও গড়ে তুলছে। যার কেন্দ্রে রয়েছে সালমা খাতুনদের মতো মানুষদের পরিশ্রম, সংকটকে সম্ভাবনায় রূপ দেওয়ার সাহস।

লেখক: শিক্ষার্থী
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ
পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি 

আরও পড়ুন

×