ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

অভ্যাস বদলেই বাঁচবে পৃথিবী– প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

অভ্যাস বদলেই বাঁচবে পৃথিবী– প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

সুমাইয়া মুবাশশিরাহ

সুমাইয়া মুবাশশিরাহ

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | ১৭:১৬ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ | ১৭:৩৩

পৃথিবী আজ এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক বোতল, শপিং ব্যাগ, চিপসের প্যাকেটসহ নানা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক দিন দিন ভয়াবহভাবে পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়ে উঠছে। যদিও প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ, কিন্তু এর ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় আমাদের অভ্যাসগত ভুলই এখন আমাদের গ্রহের জন্য চরম হুমকির কারণ।

প্লাস্টিক ও পলিথিনের নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাব আজ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। যে বস্তু শত শত বছরেও মাটিতে মিশে না, তা পোড়ালে তৈরি হয় ডাই-অক্সিন, কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস– যা জলবায়ু পরিবর্তন, বরফ গলা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। দীর্ঘ সময় পর এই প্লাস্টিক ভেঙে পরিণত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকে, যার আকার ৫ মিলিমিটারেরও কম। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ক্ষুদ্র কণা খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে– ফুসফুস, অন্ত্র এমনকি মায়ের বুকের দুধেও মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। একই সঙ্গে প্লাস্টিক দূষণ প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসেও ভূমিকা রাখছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্লাস্টিক ও পলিথিনের পুনর্ব্যবহার। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্যের বাজার রয়েছে। অথচ ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মাত্র ৩৬ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য হয়, ৩৯ শতাংশ চলে যায় ময়লার ভাগাড়ে, আর ২৫ শতাংশ ছড়িয়ে থাকে পরিবেশজুড়ে। বিশাল একটি অংশ রয়ে যায় সংগ্রহের বাইরে।

বিশেষত চট্টগ্রাম শহর এই সংকটের একটি বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামে প্রতিদিন জনসংখ্যা ও আর্থিক কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বর্জ্যের পরিমাণ। ২০২০ সালের হিসাবে শহরের জনসংখ্যা ৭০ লাখের বেশি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) তথ্যমতে, প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ৮.৮ শতাংশই প্লাস্টিক ও পলিথিন। যথাযথ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ না হওয়ার কারণে এই বর্জ্য নদীনালা, খালবিল ও মাটিতে জমে দূষণ বাড়াচ্ছে, সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি।

যদিও সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, ২০২০ সালে তা ছিল মাত্র ২০ শতাংশ। গবেষণা বলছে, ৩০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করে, ৪৬ শতাংশ কখনও করে না, আর ১৩ শতাংশ একেবারেই সচেতন নয়।

এই অবস্থায় ‘প্লাস্টিক সার্কুলারিটি’ বা চক্রাকার অর্থনীতি হয়ে উঠেছে সম্ভাবনাময় পথ। এর মাধ্যমে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে আবার ব্যবহারে ফিরিয়ে আনা যায়। এই লক্ষ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), ইউনিলিভার বাংলাদেশ ও ইপসা যৌথভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব মডেল গড়ে তুলছে।

২০২২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন তেমনভাবে সংগ্রহ করা হতো না। তবে ইউনিলিভারের উদ্যোগে সে চিত্রে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। পলিথিন সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়ার জন্য তখন গড়ে তোলা হয় একটি সংগঠিত সংগ্রহকারী নেটওয়ার্ক। এখন তিন হাজারের বেশি পলিথিন সংগ্রাহক সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন, যাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ব্যাংক হিসাব খোলা, সঞ্চয় বৃদ্ধি ও বীমা সুবিধার মাধ্যমে। ইতোমধ্যে ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইক্লিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে।

চট্টগ্রামে এখন উৎসবিন্দু থেকেই গৃহস্থালি ও প্লাস্টিক বর্জ্য আলাদা করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সংগ্রাহকরা প্রতিদিন বাসাবাড়ি, খোলা জায়গা এবং বিভিন্ন উৎস থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ করেন। এই বর্জ্য ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি হয়, সেখান থেকে যায় রিসাইক্লারের কাছে। রিসাইক্লাররা তা প্রক্রিয়াজাত করে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করেন। এভাবেই গড়ে উঠেছে একটি চক্রাকার অর্থনৈতিক কাঠামো। 

এই উদ্যোগের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো স্কুল অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম। চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীদের পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে উঠলে ভবিষ্যতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

এই সফলতা আরও বিস্তৃত করার জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা। ছোট ছোট অভ্যাসের পরিবর্তন যেমন– প্লাস্টিক কম ব্যবহার, আলাদা করে সংরক্ষণ, নিয়মিত সংগ্রাহকের কাছে হস্তান্তর; এই ছোট ছোট পদক্ষেপই হতে পারে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা।

অভ্যাস বদলেই বাঁচবে পৃথিবী। আমাদের সচেতন সিদ্ধান্তই পারে আমাদের শহর, নদী, প্রকৃতি এবং আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে।

শিক্ষার্থী
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×