ঘর থেকে শুরু হোক প্লাস্টিকমুক্তির অভিযান

সুমাইয়া আকতার
সুমাইয়া আকতার
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | ১৭:০৫ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ | ১৭:১৮
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় আট লাখ টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, যার ৩৬ শতাংশ ব্যবহারের পরপরই ফেলে দেওয়া হয়। এর বড় অংশই এককালীন (সিঙ্গেল ইউজ) প্লাস্টিক; যেমন পলিথিন ব্যাগ, পানির বোতল, খাবারের মোড়ক– যা সহজে পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে পরিবেশে থেকে যায়।
চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত হলেও, গত এক দশকে শহরটি ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণের চাপে পড়েছে। প্রতিদিন সেখানে কয়েক হাজার টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়, যার মধ্যে প্রায় ৮ দশমিক ৩ শতাংশ প্লাস্টিক। এই প্লাস্টিকের বড় অংশ যথাযথভাবে সংগ্রহ বা রিসাইক্লিং না হওয়ায় তা গিয়ে পড়ে খাল, ড্রেন, নালা ও কর্ণফুলী নদীতে। ফলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা হয়ে দাঁড়ায় শহরবাসীর নিত্যদিনের দুর্ভোগের কারণ।
পরিবেশগত দিক থেকেও চিত্র বেশ উদ্বেগজনক। বৈশ্বিকভাবে প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারে আসে। তবে বাংলাদেশের চিত্র তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো– ঢাকায় রিসাইক্লিং হার প্রায় ৩৭ শতাংশ এবং জাতীয় পর্যায়ে তা ৩১ শতাংশের মতো। তবুও বাকি বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য নানা পথে শেষ পর্যন্ত গিয়ে জমা হয় ডাস্টবিন, খোলা জায়গা, ড্রেন, নদী ও সমুদ্রে। এর ফলে সামুদ্রিক প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে, উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস ও নদীপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়, এমনকি এসব ক্ষতিকর বর্জ্য মানবদেহেও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রায় দুই লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে, যা দেশের সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য এক বড় বিপদ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
এই সংকট মোকাবিলায় চট্টগ্রামে প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। নগরীর বাংলা বাজার এলাকার গৃহবধূ খাদিজা বেগম এখন তাঁর চার সদস্যের পরিবারে প্রতিদিন ঘর থেকেই আলাদা করে রাখেন এককালীন প্লাস্টিক। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এসব বর্জ্য ফেলার বদলে বিক্রি করবেন স্থানীয় রিসাইক্লারদের কাছে। এখন তিনি সপ্তাহে প্রায় এক কেজি প্লাস্টিক জমিয়ে বিক্রি করেন। এতে সামান্য আয় যেমন হচ্ছে, তেমনি এই অভ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর ছোট সন্তানদের মধ্যেও। খাদিজা বলেন, ‘আগে এসব প্যাকেট আর বোতল ড্রেনে ফেলতাম। এখন বুঝি, এগুলো জমলে পানি আটকে যায়, রোগ ছড়ায়। ঘর থেকেই যদি শুরু না করি, শহর পরিষ্কার হবে কীভাবে?’
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উদ্যোগে অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে পরিবারে সচেতনতা ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক নারী এখন স্থানীয়ভাবে পাটের ব্যাগ, কাগজের প্যাকেট ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ব্যবসাও গড়ে তুলছেন– যা পরিবেশের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা গেলে এই দূষণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এটি শুধু পরিবেশ রক্ষাই নয়, জনস্বাস্থ্যের দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের অতি সূক্ষ্ম কণিকা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) এখন আমাদের খাদ্য, পানি এমনকি রক্তেও পাওয়া যাচ্ছে– যা ক্যান্সার, হরমোনজনিত সমস্যা এবং শিশুদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি বাড়ায়।
ঘরের ছোট একটি অভ্যাসই হতে পারে বৃহৎ পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা। পরিবেশের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ হোক দায়িত্বশীল ও স্থায়ী– আজ থেকেই।
শিক্ষার্থী
নৃবিজ্ঞান, তৃতীয় বর্ষ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- প্লাস্টিক বর্জ্য
- বিশ্ব পরিবেশ দিবস