ডলারের দাম ও মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে

মামুন রশীদ
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ০৩:২৩ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ০৩:২৩
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার আসলে কত– জিজ্ঞেস করলে সরকারবহির্ভূত অনেকেই সোজা উত্তরটি এড়িয়ে যেতে চান। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি, সরকারি হিসাবেই সব মিলিয়ে এই অঙ্কটি প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছিল। খাদ্যমূল্য বিবেচনায় অনেকের মতে এটি ১২ শতাংশের বেশি চলে গেছে। একটি বাণিজ্যিক দৈনিক আবার আমাদের মূল্যস্ফীতি ঝুড়ির পুরো ব্যবচ্ছেদ করে দেখিয়েছে কোথা দিয়ে কী হচ্ছে।
তবে প্রায় সবাই একমত যে, সরকার প্রদত্ত মূল্যস্ফীতির অঙ্কে– ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। সরকারি কর্তাব্যক্তিদেরও অনেকে বলছেন– উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। তবে এর কারণ হিসেবে কেউই আর আন্তর্জাতিক বাজার বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর পুরো দোষ চাপাতে নারাজ। বরং অঙ্গুলি হেলন করছেন স্থানীয় ভোগ্যপণ বাজার নিয়ন্ত্রক কিছু অলিগার্ক, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দুর্বলতা আর বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অনিশ্চয়তার দিকে।
তবে অনেকেই হয়তো জানেন না, তাদের জন্য হয়তো অদূরভবিষ্যতে আরও খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রতি ব্যারেলের দাম ৯৭ ডলারে উঠেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তা বেড়েছে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তা ও সরকারের। কারণ, ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। এতে আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে ডলারের ওপর নতুন করে চাপও বাড়বে।
এদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও সমন্বয় করতে হবে। তখন দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। এমনিতেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পত্রিকান্তরে জানা গেছে আগস্টে এ হার ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
করোনার সংক্রমণের সময় ২০২০ সালের ২৭ এপ্রিল জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামে। ওই সময়ে বিশ্বে লকডাউনের কারণে জ্বালানি তেলের ব্যবহার হ্রাস পাওয়ায় দামও কমেছিল। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ২০ ডলার। এরপর থেকে দাম কিছুটা বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে তেলের দাম আবার বাড়তে থাকে। ওই বছরের ১৪ মার্চ বেড়ে সর্বোচ্চ ১২৭ ডলারে ওঠে। এরপর থেকে সামান্য ওঠানামার মধ্য দিয়ে কমতে থাকে। ২২ জুন তা কমে ৭০ ডলারে নামে। এরপর সৌদি আরব জ্বালানি তেল উত্তোলনের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। রাশিয়াও কম দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দাম বাড়ানোর কথা বলে। এ থেকে আবার তেলের দাম বাড়তে থাকে। গেল সপ্তাহে তা বেড়ে ৯৭ ডলারে ওঠে। অচিরেই তা ১০০ ডলার অতিক্রম করবে বলে জ্বালানি বাজার-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কারণ করোনার ধকল ও বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার বাড়তে শুরু করেছে। এর প্রভাবে জ্বালানি তেলের ব্যবহারও বাড়ছে। অন্যদিকে প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো এর উৎপাদন কমাচ্ছে। ফলে তেলের বাজারে আবার নতুন করে অস্থিরতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এতে বাংলাদেশের বাজারেও উদ্বেগ ছড়িয়েছে। কেননা দেশের মোট আমদানির ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ জ্বালানি তেল। এ ছাড়া গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি মিলে প্রায় ২৫ শতাংশ ব্যয় জ্বালানি খাতে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে অন্যান্য জ্বালানির দামও বাড়তে থাকে। এ কারণে এই খাতে ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এখন বকেয়া জ্বালানি তেলের দাম পরিশোধ করতে পারছে না। এতে অনেক বিদেশি কোম্পানি দেশে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে। আগে জ্বালানি তেলের দেনা পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়া হলেও এখন সংগত কারণেই তা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গেল বছরের ২২ এপ্রিল জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলারের নিচে নেমে যায়। এতে তেল আমদানিতেও একটু স্বস্তি ছিল। কারণ তেল আমদানি ব্যয় কমছিল। এখন তেলের দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয়ও বাড়বে। এতে ডলার সংকট আরও প্রকট হবে। এমনিতেই আমদানিতে ডলার মিলছে না। তখন সংকটের কারণে ডলারের দাম বাড়ার পাশাপাশি শিল্প খাতের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। তখন মূল্যস্ফীতির হারও বাড়বে, যা মানুষকে আরও ভোগাবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তেলের দাম সমন্বয় করার বিষয়ে আইএমএফের শর্ত রয়েছে। সে হিসাবে বাংলাদেশে তেলের দামের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি। এ কারণে দেশে তেলের দাম বাড়ানোর চাপ আসতে পারে আইএমএফের কাছ থেকে। অক্টোবরের শুরুতেই আইএমএফের টিম আসছে। তখন তারা দাম বাড়াতে চাপ দিতে পারে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ প্রায় ৯৫০ কোটি ডলারের বেশি খরচ হয়েছে। এর মধ্যে অনেক দেনার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যেগুলো পরিশোধ করা হয়নি। এর আগের অর্থবছরে খরচ হয়েছিল ৮০০ কোটি ডলার।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা, বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতায় মূল্যস্ফীতি কমানোর একমাত্র পথ হতে পারে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো, বাজারে ব্যক্তি খাতের আরও অপারেটরদের কাজ করতে দেওয়া, সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করে সংকুচিত করে আনা এবং বাজারে ডলারের বহু রকম বিনিময় হারের মধ্যে সমন্বয় সাধন। জোর করে বা ঘোষণা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ কোথাও কাজ দেয়নি, দেবেও না। তবে স্বল্পসংখ্যক অলিগার্কদের গতিবিধি নিয়ে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে, বিশেষ করে তারা যদি বিশেষ আনুকূল্যপ্রাপ্ত হয়। সেই সঙ্গে নতুন টাকা ছেড়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ না বাড়ানোর দিকেও সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। ‘জ্বি হুজুরের’ পরিবর্তে নীতিনির্ধারকদের এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমপর্যায়ের দেশগুলো কী করেছে সেটাও জানতে হবে বৈকি।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক