ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

পাখি হতে চাই

পাখি হতে চাই

রোকেয়া সুলতানা

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১৩:০৮ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১৩:০৮

যদি আমি হতেম পাখির ছানা, উড়ে বেড়াতাম বিশ্বজুড়ে কোথায় কোন রতন কুঠি কোন পাহাড়ের গোপন চূড়ায়। সাগরতলে মৎস্য কুমারীর দেশে। 

আমাদের দেশে বেশির ভাগ মেয়ের পাখা কেটে দেওয়া হয় ছোটবেলায়। লেখাপড়া না শেখানো, বাল্যবিয়ে ও নানা রকম ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারে মেয়েদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়। আমি নিজেকে ব্যতিক্রম মনে করি।

এমন এক অপ্রচলিত পেশা বেছে নেয় মুষ্টিমেয় লোক, এমনকি পুরুষরাও এই পথে হাঁটে না। আমি যখন আঁকিয়ে শিল্পী হতে চাইলাম, অনেক বাধা না পেলেও কোনো বিশাল উৎসাহও পাইনি। তবুও চারুকলায় ভর্তি হলাম। মনে মনে স্বপ্নের রঙিন পাখা উড়িয়ে দিলাম দিকদিগন্তজুড়ে। এ পথে তেমন সাথি নেই। নিজেকে একাই চলতে হয়, পথ খুঁজে নিতে হয়। দূরে যে আলোকশিখা আলোকিত করে রেখেছে, সেই পথে প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকি। কখনও হোঁচট খাই, রক্তাক্ত হই, মন ভেঙে যায়। তবুও পরম আশ্বাস ও উৎসাহে এগিয়ে যেতে থাকি।

আমার জীবনে সফলতার শেষ নেই। এত কিছু পেয়েছি, যার কোনো তুলনা হয় না। পরিশ্রম ছাড়া কিছু অর্জন করা সম্ভব না। ত্যাগ, দৃঢ়তায় লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে চলা। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় নবীন শিল্পকলা প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাই। চারুকলায় পড়াকালীন প্রতিবছর আমি বিভিন্ন মাধ্যমে পুরস্কার পেতাম। 

এভাবে জাতীয় পুরস্কারসহ এসেছে ভারত ভবন থেকে গ্রান্ড পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং পরবর্তী সময়ে প্রথম নারী শিল্পী হিসেবে এশিয়ান বিয়েনালে পুরস্কারপ্রাপ্তি। ফ্রান্সের বৃত্তি পাওয়া এর মধ্যে এক অসাধারণ অনুভূতি। ফরাসি দেশ শিল্পীদের তীর্থস্থান। সেখানে গিয়ে কাজ করতে পারার জন্য আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। খুব সুন্দর একটা সময় কেটেছে আমার। সেখানে যেতে পারায় আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।লুভর, মেট্রোপলিটন জাদুঘরে আমি দেখলাম আশ্চর্য সব শিল্পকর্ম। আমার প্রিয়তম শিল্পী এডওয়ার্ড মোনের ‘ওয়াটার লিলি’ অনুভব করতে পারা অসাধারণ এক অনুভূতি। ভালোবাসা– রঙের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা– মোনে একজন অসাধারণ শিল্পী। নিজের চোখের সামনে মোনের বিশাল বিশাল ‘ওয়াটার লিলি’। তিনি চিত্রশিল্পে ইমপ্রেশনিস্ট ধারার প্রবর্তকদের একজন। এরপর শিল্পের আরেক বিশাল ক্ষেত্র আমেরিকায় আমার পদার্পণ। চারুকলা অনুষদের শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছি বিভিন্ন কাজকর্মে। ভারতের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস (আইসিসিআর) আমার রেটরোস্পেকটিভ করেছে ২০২২ সালে।

তবে ধারণা করি, আরও অনেক মেয়েই, যারা এই পাখা লাগাতে পেরেছে, মনের আলো জীবিত করতে পেরেছে; পাছে লোকে কিছু বলে– সেখান থেকে বের হতে পেরেছে। কারণ একজন নারী, একজন কন্যা, একজন ভগিনী, জায়া, জননী– সে ঠিকই তার সঠিক পথটি বেছে নিতে পারে যদি সুযোগ পায়। আরেক শিল্পক্ষেত্র আমেরিকায় আমার পদার্পণ ফুলব্রাইটার হিসেবে। রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পেলাম সরকার থেকে। এটি আমার এক বিশাল পাওয়া। দেখলাম, আমার মতো আরও অনেক নারী ফুলব্রাইটার সারা পৃথিবী থেকে এসেছে। বাংলাদেশ থেকেও বিভিন্ন সাবজেক্টে গত ত্রিশ বছরে বহু নারী স্কলারশিপ পেয়েছে। 

আমার কেন জানি মনে হয়, মেয়েরা অনেক কঠিন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও কোথায় যেন তারা এগোতে পারছে না। সামাজিক কূপমণ্ডূকতা ও সামাজিক অবক্ষয় অবিচারের কারণে। যেমন একটা মেয়ে যতই ভালো কাজ করুক, সমাজ তাকে নিয়ে কথা বলবে, তাকে নিয়ে যতটা পারবে অপপ্রচার চালাবে। আমরা দেখি, আমাদের নারী ফুটবল দল, ক্রিকেট দলকে প্রচুর হেনস্তার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং হচ্ছে বারবার। এটি ১০০, ৫০ বা ১০ বছর আগের ঘটনা নয়। আমার ধারণা, বছর দুয়েক আগে তারা যখন বাসে করে তাদের নিজ অবস্থানে ফিরছিল, তখন বাস যাত্রীসহ অন্য লোকেরা প্রচুর সমালোচনা করেছিল। টিপ্পনী করেছিল, অবহেলা দেখিয়েছিল। সামাজিক অবক্ষয় তাদের এ সমাজের মুখোমুখি করেছিল। এই যখন সমাজের অবস্থা, তখন মেয়েদের এগোনোর পরিস্থিতি কী? তারা এক পা এগোয় তো দশ পা পেছায়। এটা খুবই হৃদয়বিদারক!

আমি নিজের কর্মক্ষেত্রেও দেখেছি, মেয়েদের সবসময় একপাশে সরিয়ে রাখা বা তুচ্ছ করার প্রবণতা আমাদের সমাজের শিকড়ে প্রোথিত। বাড়িতে একটি মেয়ে যতই কাজ করুক, যতই সফল হোক, তাকে বেশির ভাগ সময় তুচ্ছ করে দেখা হয়।

মেয়েরা টাকা রোজগার করছে, কাজ করছে। পরিবারকে সাহায্য করছে– বাবা-মা অথবা স্বামীকে। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় অবদান রাখছে; কিন্তু দিন শেষে তাদের তুচ্ছ অবহেলায় একপাশে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। আমাদের এ পুরুষতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোয় পুরুষরাই যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নারীদের অবস্থান কোথায়, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। তবুও পুরুষদের পাশাপাশি সহমর্মিতায়, সম্মানের সঙ্গে একটি সমাজ, একটি জাতি বা দেশ গড়ে তোলার ও এগিয়ে নেওয়ার জন্য নারীরা নিজেকে সর্বোপরি নিয়োজিত রেখেছে। তারা সব রকমের ত্যাগ স্বীকার করছে। সেই ১৯৭১ সালে নিজেদের নারীত্বের ওপর আঘাত সহ্য করেও বীরবিক্রমে লড়াই করে জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিল। এখনও তারা দেশকে উন্নত করার প্রকল্পে পুরুষের সঙ্গে পা মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও প্রাপ্য সুনামটুকু অনেক ক্ষেত্রে তারা পাচ্ছে না। গৃহকর্মী থেকে অফিসের উচ্চস্তরে, আদালতে, শিল্প-সাহিত্য সর্বক্ষেত্রে তারা অবদান রেখে যাচ্ছে। আজ যদি আমরা পোশাকশিল্পের নারীদের কথা ভাবি, তাহলে নারীর অবদান নিয়ে আর কিছুই বলার থাকে না। গত কয়েক যুগ কীভাবে আমাদের অর্থনীতিতে তারা অবদান রেখেছে, তাদের এই মহিমান্বিত ত্যাগ নিয়ে কীভাবে সম্মান জানাব, তার বর্ণনা করব জানি না।

তবে সত্যিকারের নারীদের সফলতা, সার্থকতা আমি তখনই বলব যখন এ দেশে একজন সিএনজিচালক, একজন বাসচালক বা ট্রাকচালক হিসেবে এবং সর্বক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কাজ করতে পারবে, সম্মান পাবে। তখনই আমরা বুঝব যে নারী স্বাধীন হয়েছে। এখানে আমাদের মুষ্টিমেয় কিছু নারীর সফলতা নিয়ে আসলে বিশেষ করে বলার কিছু নেই।

আমি আশাবাদী মানুষ। তাই বলব, যা হয়েছে তা-ই বা কম কী! এই যে দলে দলে নারী গ্রাম থেকে এসে শহরে বাসা করে আমাদের গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পকারখানায় নিজেদের নিয়োজিত রাখছে– সফলতার গল্প এখান থেকেই শুরু!

শিল্পী হিসেবে আমি স্বপ্ন দেখি– যখন একজন নভেরা আসবেন, একজন নারী পিকাসোর আগমন হবে। শিল্প যাত্রাপথে পুরুষের পাশাপাশি একজন শামীম শিকদারের যুদ্ধ দেখেছি। আমি এটিকে সংগ্রাম বলতে চাই না। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর যুদ্ধ দেখেছি। সেই যুদ্ধ এখনও আমি এবং আমরা বয়ে চলেছি।

কিন্তু আমি জানি, এখানে, এই দেশে এখনও একজন নারী শিল্পী ‘গুয়ের্নিকা’ রচনা করে চলেছে। শিল্পের ভাষা, রং ও রেখায় এবং অন্যান্য মাধ্যমে কথা বলিষ্ঠভাবে বলে চলেছে– শুধু স্বীকৃতির অপেক্ষা। 

লেখক: চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ

আরও পড়ুন

×