সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণে সবার আগে প্রয়োজন জীবনের নিরাপত্তা

ছবি :: মামুনুর রশীদ
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:২৭ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:২২
পেশাগত নিরাপত্তাহীনতা, স্বাস্থ্যসহ আইনি জটিলতা, প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক সমস্যার মধ্য দিয়ে স্যানিটেশন কর্মীদের জীবন চলছে। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হন। যার মধ্যে রয়েছে বিপজ্জনক সামগ্রীর সংস্পর্শে আসা, ভারী জিনিস তোলা, চলন্ত যন্ত্রপাতির আঘাত, ট্রাফিক দুর্ঘটনা এবং বর্জ্য ও দূষিত পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সমস্যা। স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য এই ঝুঁকিগুলো প্রশমিত করতে এবং তাদের প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালনের সময় তাদের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম এবং প্রটোকল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে তাদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
গত ১২ নভেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল সভাকক্ষে ‘স্যানিটেশন কর্মীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। সমকাল ও ওয়াটারএইড বাংলাদেশ যৌথভাবে এর আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের সার্বিক সহায়তায় ছিল বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
হাসিন জাহান
ব্যক্তি মালাকানাধীন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করেন, তাদের একটা নীতিমালায় আনা প্রয়োজন। এসব নীতিমালায় স্যানিটেশন কর্মীদের বেতন বৈষম্য দূর করা, ন্যূনতম মজুরি, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ক্ষতিকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো থাকতে হবে। নারী স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি ভাবা জরুরি। পৌরসভা কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে নারী–পুরুষ সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট রাখা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করাসহ তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সারাদেশে সার্বিকভাবে সব পর্যায়ে একটা জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। স্যানিটেশন কর্মীদের সম্মান দেওয়ার মনোভাব আমাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ক্ষতিকর বর্জ্যকে অন্যান্য বর্জ্য থেকে আলাদা করে সেটি ব্যবস্থাপনায় সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
শহীদুল ইসলাম
দেশের পৌরসভাগুলো স্যানিটেশন কর্মীদের মাধ্যমে জনগণকে সেবা দিচ্ছে। তাই পৌরসভাগুলোরও উচিত স্যানিটেশন কর্মীদের সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা। সিটি করপােরেশন কিংবা পৌরসভাগুলোতে স্থায়ী-অস্থায়ী পর্যায়ে কর্মচারী কাজ করেন। আবার অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও সিটি করপােরেশন কিংবা পৌরসভাগুলো অনেক কাজ করায়। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, স্যানিটেশন কর্মীদের কোনও তালিকাই নেই। এক্ষেত্রে তারা নানা বৈষম্যের শিকার হন। বিশাল সংখ্যক স্যানিটেশন কর্মী পৌরসভাগুলোতে কাজ করেন। অথচ পৌরসভা তাদের কোনো সেবাই দেয় না। এসব কর্মীর তালিকা চাইলে পৌরসভাগুলো তা দিতে পারবে না। কর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ পান না। পৌরসভার বাজেটে তাদের কল্যাণের জন্য কোনো বরাদ্দও থাকে না। তাদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ দিয়ে তালিকা করে লাইসেন্সের আওতায় আনা উচিৎ।
২০১৭ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটা পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল যে, পৌরসভাগুলো স্যানিটেশন কর্মীদের তালিকা করে তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করবে। তাদের মজুরি নির্ধারণ করে দেবে। বিভিন্ন নিরাপত্তা উপকরণ সরবরাহ করবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হচ্ছে কীনা– সেটা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেখভাল করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
গৌতম মণ্ডল
সপ্তাহে সাত দিনই সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত স্যানিটেশন কর্মীরা কাজ করেন। এটা শ্রম আইনের পরিপন্থি। সেখানেও নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তারা। তারা এক দিনও ছুটি পান না। এটা অমানবিক। বিবেচনার জায়গা হলো, শ্রম আইন অনুযায়ী তাদের যে ছুটি পাওয়ার কথা, তারা যেন সে ছুটিটা পান। তাহলে তারা শক্তি পাবেন। পরিবারকে সময় দিতে পারবেন। স্যানিটেশন কর্মীদেরও নিজেদের পক্ষ থেকে সচেতন হতে হবে। অন্য ক্ষেত্রের শ্রমিকরা কেমন মজুরি পাচ্ছেন– এ বিষয়েও তাদের খোঁজ রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্যানিটেশন কর্মীরাও সেই দাবি জানাতে পারেন।
তাহমিদ হোসেন
হরিজন সম্প্রদায় কিংবা স্যানিটেশন কর্মীরা সমাজে নানাভাবে অবহেলার শিকার হন। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রমিক কল্যাণ তহবিল নামে একটা তহবিল আছে। এই তহবিল সরকারের তালিকাভুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলো নিয়ে কাজ করে। স্যানিটেশন কর্মীদের কাজও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে আবেদন করলে স্যানিটেশন কর্মীরা সরকারি ভাতা পাবেন। সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে স্যানিটেশন কর্মীদের আবাসনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, সমাজের মানুষকেও সচেতন হতে হবে। আমরা এখনও বাসা–বাড়িতে ময়লা আলাদা করা শিখিনি। আমরা সব ময়লা এক সঙ্গে রাখি। অথচ আমাদের উচিত পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্যগুলোকে আলাদা করা।
ইয়াসিন আরাফাত
স্যানিটেশন কর্মীরা আমাদের সমাজে যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি পান না। তারা যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন সেগুলোর মধ্যে প্রথমটিই হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। দূষিত পরিবেশে কাজ করার কারণে তারা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাব রয়েছে; কর্মস্থলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সমাজে তাদের প্রতি একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং তারা সামাজিকভাবে বঞ্চিত। তাদের আয় স্থিতিশীল নয় এবং অনেকেরই সামাজিক নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়াও, তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পাওয়া যায় না। তাদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং সুশীল সমাজের সবাইকে মিলে স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
পংকজ বাসফোর
ঢাকার দুই সিটি করপােরেশন গঠিত হওয়ার পর আমাদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হতো। গত প্রায় ২০ বছর ধরে স্থায়ী নিয়োগ বাতিল করে আমাদের অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিটি কর্পোরেশনের আইন অনুযায়ী, আমাদের শতভাগ বাসস্থান নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তা করা হয় না। আমরা কোথাও বাসা ভাড়া পাই না। আমরা যদি বাসা ভাড়া নিতে যাই, পরিচয় গোপন করতে হয়। এক্ষেত্রে পরিচয় জানতে পারলে আমাদের বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে আমাদের যে থাকার জায়গা দেওয়া হয়েছে, সেখানে কেবল একটা রুম, একটা ড্রয়িং রুম আর একটা রান্না ঘর আছে। সেখানে ১৫ থেকে ২০ জন লোক বসবাস করেন। সেখানে আমাদের পালা করে একেকজনকে ঘুমাতে হয়। এভাবেই আমরা সভ্য সমাজে বসবাস করছি।
আমাদের বেশির ভাগ সময় রাতে রাস্তায় কাজ করতে হয়। রাতে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কেউ কেউ মারাও গেছেন। এছাড়া আমাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি নিতে চায় না। ভর্তি হলেও পরবর্তী সময়ে সামাজিক চাপে তাদের বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়। আমাদের কোনো ধরনের ছুটি নেই। এটা তো ঢাকার অবস্থা। ঢাকার বাইরে বৈষম্য আরও প্রকট। শ্রীমঙ্গলে স্যানিটেশন কর্মীদের মাসে মাত্র ৫০০ টাকা বেতন দেওয়া হয়। এসব কর্মী পৌরসভার কলোনিতে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে এত কম মজুরিতে কাজ করেন। তারা কোনো ধরনের ভাতা বা ছুটি পান না। দেশের সকল পৌরসভায় আমাদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করতে হবে। সকল পৌরসভায় আমাদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।
নাগমনি লতা
আমি তেলেগু সম্প্রদায়ের মানুষ। নাইট শিফটে কাজ করি। রাত ৮টার দিকে যাই, বাসায় ফিরি রাত ১টা কিংবা ২টার সময়। রোদ-বৃষ্টিতে এমনকি ঈদ ও অন্যান্য উৎসবেও আমরা ময়লা পরিষ্কার করি। বেতন পাই মাত্র ১৭ হাজার টাকা। আমার তিন মেয়ে। গত বছর বড় মেয়ে এসএসসি পাস করে। টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি করাতে পারিনি। ছোট দুই মেয়েকে এখনও পড়াচ্ছি। আমার শাশুড়ি ক্যান্সার আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য ঋণ করতে হয়েছে। এখন সেই ঋণ পরিশোধ করছি। বর্তমানে পরিস্থিতিতে আমি যে কাজ শেষে বাসায় ফিরতে পারবো, তার নিশ্চয়তা বা নিরাপত্তা নেই। এদিকে, আমার চাকরি যতদিন আছে, ততদিন বাসস্থান থাকবে। আমি মারা গেলে আমার সন্তান কিংবা স্বামী কেউ বাসস্থান সুবিধা পাবে না। আমি অসুখে পড়ে বাসায় বসে থাকলেও চিকিৎসা সহায়তা পাবো না। সাজেদা ফাউন্ডেশন স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য যে সেবা-কার্ড দিয়েছে, তাতে কিছুটা সুবিধা পেলেও ডাক্তারের ফি, দামি দামি ওষুধ কেনার খরচ জোগাতে পারি না। এছাড়া বোনাস না পাওয়ায় এ সামান্য আয়ে পূজার দিনে পরিবারের মানুষদের জন্য ভালো খাবার রান্না করতে পারি না। সন্তানদের নতুন পোশাক কিনে দিতে পারি না। ১২ বছর ধরে দৈনিকভিত্তিক কাজ করছি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আমার মামা কাজ করতেন। তিনি মারা গেলে মামার নিয়োগেই আমি কাজ করছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা আগে যোগ দিয়েছিল স্থায়ী ভিত্তিতে। এখন যারা কাজ করছে তারা স্থায়ী না। নারীরা স্যানিটেশনের কাজ করতে গিয়ে টয়লেট সুবিধা পান না। ফলে পিরিয়ডের সময় ঠিকমতো পরিষ্কার হতে পারি না।
নির্মলা
আমরা অনেক সময় প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কাজ করি। কাজের মাঝে যে আমরা কোথাও বসে বিশ্রাম করবো, এমন কোনো সুবিধা নেই। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়লে কারও বাসায় গিয়েও বসতে পারি না। তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আমাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
হালিমা বেগম
ঢাকার কালশীতে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকি। পাঁচ মেয়ের মধ্যে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। বাকি তিন মেয়ে ও স্বামী নিয়েই আমার বসবাস। স্বামীও একই কাজ করেন। বেতন মাত্র ১০ হাজার টাকা। অন্যান্য স্যানিটেশন কর্মীর মতোই প্রতিনিয়ত অবহেলার শিকার হই। অনেকে আছেন, ভাঙা কাঁচ এলামেলোভাবে রাখেন। তারা পারতেন একটা বস্তায় ভরে আলাদা করে রাখতে। ফলে প্রায় সময় আমার বা অন্য সহকর্মীর হাত পা কেটে যায়। অভাবের কাছে আমরা অসহায়, তাই এই কাজ ছাড়তে পারছি না। দশ বছর ধরে কাজ করি। প্রথমে পেতাম ৬ হাজার। পরে বেতন বেড়ে ৭ হাজার হয়। এখন পাই ১০ হাজার টাকা।
আব্দুস সালাম
যা বেতন পাই, তা দিয়ে অনেক কষ্ট করে চলতে হয়। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে ভালো খাবারও জোটে না। কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসাও করাতে পারিনি। মালিকও কোনো সহযোগিতা করেননি। চিকিৎসা সেবা পেতে সম্প্রতি ডিএসকে একটি কার্ড দিয়েছে। ওই কার্ড ব্যবহার করে অনেক কম খরচে চিকিৎসা সেবা নিয়েছি। এখন অনেকটা সুস্থ আছি। আমরা চারজন মিলে কাজ করি। ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা করে বেতন পাই আমরা। এখানে বেতন বৈষম্য অনেক। এর মধ্যে প্রতি মাসের বেতন ঠিক সময়ে পাই না। এ মাসেরটা ওই মাসে, আগামী মাসেরটা পরের মাসে মেলে। এভাবে ঢাকা শহরে চাকরি করে সন্তানদের লেখাপড়া করানো অসম্ভব। এ পেশায় আছি, কিন্তু নেই নিয়োগপত্র। কোনো প্রতিষ্ঠানের আওতায়ও কাজ করছি না। বাড়ির মালিক সমিতির সাথে চুক্তিতে কাজ করছি। প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ৮০টা বাড়ির ময়লা পরিষ্কার করি। বাসা ভাড়ার সাথেই ময়লার খরচ তুলে নেন বাড়ির মালিকরা। প্রতি মাসে তারা ৬৪ হাজার টাকা ময়লা বাবদ তোলেন। আমাকে দেন মাত্র ১০ হাজার টাকা বেতন। এ টাকা থেকেই আরেকজন সহকর্মীর বেতন দেই। গাড়ির মেরামত করানো হয়। এখানেও বৈষম্য। আমি মাস্টার রোলে আছি। কিন্তু নিয়োগকর্তা মাঝখানের একজন। আমি জানি না আমার জন্য কত টাকা বরাদ্দ আছে। এজন্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়া থাকা দরকার।
পারুল আক্তার
চারপাশের মানুষ আমাকে অবহেলা করে। তারা বলে, ২০ হাজার টাকা দিলেও স্যানিটেশনর কাজ তারা করবে না। আমার বেতন মাত্র ১০ হাজার টাকা। এ টাকায় কীভাবে একজন মানুষ পরিবার নিয়ে ভালো থাকতে পারে? খাওয়া-দাওয়া, বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ, বাসা ভাড়া, যাতায়াত খরচ চালানো খুবই কঠিন। অসহায়ভাবে জীবনযাপন করি। কারোর বাড়িতে ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে এক গ্লাস পানি চাইলে, তাও দেয় না। এ পেশার কারণে মানুষের কাছে কোনো সম্মান পাই না। যে স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করিয়েছি, সেখানে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে হয়েছে। কারণ স্যানিটেশনকর্মীর সন্তান জানতে পারলে অবহেলার শিকার হতে হবে আমার সন্তানকে। এখনও সমাজের মানুষ মনে করে, স্যানিটেশনকর্মী খুবই নিচু পদের কাজ। সবাই দূরত্ব বজায় রেখে চলে। আমার পরিচয় জানার পরে আশপাশের কয়েকজন আমার হাতের খাবারও ফিরিয়ে দিয়েছে।
শ্রী টার্জেন বাসফোর
অনেক সময় বাসায় ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে ভাঙা কাঁচ, ব্লেড কিংবা অন্য কিছুতে হাত পা কেটে যায়। আবার অনেক বাড়িতে ময়লা পরিষ্কার করতে ভাঙা ট্যাঙ্কিতে পিছলে পড়ে হাত পা ভেঙে ফেলেন স্যানিটেশন কর্মীদের কেউ কেউ। অথচ কোনো সেবা বা সহযোগিতা পাই না। কেউ প্রতিবাদও করে না। তারা পারতেন নির্দিষ্ট স্থানে ময়লাগুলো রাখতে। কিংবা ভাঙা কাঁচ বা বোতল বস্তায় ভরে আলাদা করে রাখতে। দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানিতে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই অসুখে ভোগেন। একজন স্যানিটেশন কর্মীকে চিকিৎসাসেবা পেতে যেসব সুযোগ-সুবিধা দরকার, তা থেকেও বঞ্চিত আমরা। ময়লা নাড়তে গিয়ে হাত-পা কাটার ভয় থাকলেও পৌরসভা থেকে কোনো নিরাপত্তা দেওয়া হয় না আমাদের। বর্তমান সমাজে যেখানে ৫০০ টাকা হাজিরার নিচে কোনো কাজ হয় না, সেখানে হাজিরা হিসেবে আমরা পাই মাত্র ২৪০ টাকা। করোনার সময়ে মানুষে ভয়ে আতঙ্কে ঘর থেকে বের হয়নি। সেই সময় আমরা স্যানিটেশন কর্মীরা শহর পরিষ্কার রেখেছি। অনেক মুসলিম স্যানিটেশন কর্মী আছেন, যারা হোটেলে ঢুকে ভাত খেতে পারেন। আমরা পারি না। আমাদের বসতেও দেয় না। মানুষ হিসেবে ন্যূনতম মর্যাদাটুকু আমরা পাই না। আমাদের ভবিষ্যৎ কী? সন্তানদের ভবিষ্যৎই বা কী হবে?
সুপারিশ
ব্যক্তি মালাকানাধীন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করেন তাদের একটা নীতিমালায় আনা প্রয়োজন। এসব নীতিমালায় স্যানিটেশন কর্মীদের বেতন বৈষম্য দূর করা, স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো, ন্যূনতম মজুরি, ঝুঁকিভাতা, উৎসব ভাতা, সাধারণ ও মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ক্ষতিকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো থাকতে হবে।
নারী স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি জরুরি। পৌরসভা কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে নারী-পুরুষ সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট রাখা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করাসহ স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ক্ষতিকর বর্জ্য অন্যান্য বর্জ্য থেকে আলাদা করে সেটির ব্যবস্থাপনায় সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সারাদেশে সার্বিকভাবে সব পর্যায়ে একটা জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। স্যানিটেশন কর্মীদের সম্মান দেওয়ার মনোভাব আমাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। তাদের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। স্যানিটেশন কর্মীদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ দিয়ে তালিকা করে তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা যেতে পারে। এছাড়া তাদের ইনসেনটিভ কিংবা ভালো কাজ করলে পুরস্কারও দেওয়া যেতে পারে।
ক্ষেত্রবিশেষে তারা ভালো কাজ না করলে লঘু শাস্তিরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারি উদ্যোগগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা– তা মনিটর করতে হবে। একইসঙ্গে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পৌরসভাগুলো গাইডলাইন তৈরি করে বাড়ি তৈরির সময় স্যানিটেশন কর্মীদের নির্বিঘ্নে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে পারে– এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে ভবনের মালিকদের নির্দেশনা দিতে পারে। স্যানিটেশন কর্মীদের বিষয়ে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে তাদের জানাতে হবে। স্যানিটেশন কর্মীদের মধ্যে সঞ্চয়ের মনোভাব তৈরি করতে হবে। তারা অল্প অল্প করে কিছু টাকা সঞ্চয় করে বড় কোনো কাজ করতে পারেন।
- বিষয় :
- নিরাপত্তাহীনতা