ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অবহেলা অনাদরে জীবন

অবহেলা অনাদরে জীবন

নতুন বাবুপাড়া এলাকার হরিজনপল্লির আলো রানী

আমিরুল হক, নীলফামারী

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৩৩ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:০৭

হরিজন সম্প্রদায়ের কয়েকজন স্যানিটেশন কর্মী কাজ শেষে সকালে নাশতা করার জন্য হোটেলে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন। এ সময় হোটেলের মালিক ও কর্মচারীরা তাঁদের বাধা দেন। হোটেলের বাইরের একপাশে নিচে বসে তাদের নাশতা সারতে বললেন। বাধ্য হয়ে তারা সেখানে বসে খাবার খেলেন। সম্প্রতি নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌর শহরের শহীদ ডা. জিকরুল হক সড়কে এমনি চিত্র দেখা যায়। এটিই প্রথম নয়, এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে বলে অভিযোগ হরিজন সম্প্রদায়ের।

হরিজন সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিষ্কার-স্যানিটেশনর কাজ করায় অনেকে তাঁদের ‘নিচু জাতের’ মনে করেন। এখনও তাঁরা এ সমাজের মানুষের কাছে সম্মান পান না। সবাই দূরত্ব রেখে চলে। শুধু তাই নয়, তাদের শিশুদের সঙ্গে স্কুলের অন্যান্য শিশু খুব একটা মিশতে চায় না। এ সম্প্রদায়ের গোত্রভিত্তিক বিয়েরীতি এখনও প্রচলিত। এক গোত্রের মানুষ অন্য গোত্রের কাউকে বিয়ে করতে পারে না। বেশি পড়ালেখা জানা নিজ গোত্রের মধ্যে যোগ্যপাত্র বা পাত্রী না থাকলে কম পড়াশোনা জানা ব্যক্তির সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। এটা হরিজনদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। পড়াশোনা যাই করুক না কেন তাদের স্যানিটেশনের কাজই করতে হচ্ছে।

এ ধরনের মানসিকতার কারণেও তার শিক্ষার সুযোগ গ্রহণে অনাগ্রহী। হরিজনদের মাঝে বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ের প্রবণতা অনেক বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে বিচ্ছেদেরও সংখ্যাও বাড়ছে। হরিজনদের মাঝে নারী সহিংসতার হারও কম নয়। এ শহরে হরিজনরা রেলের জমিতে বাস করছেন। প্রায় সময় তাদের উচ্ছেদের হুমকি দেওয়া হয়। এছাড়া তাদের জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি কোনো আবাসনপল্লি। ফলে এক ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া তারা পান না কোনো সরকারি খাদ্য সহায়তা, শীতবস্ত্র বা অন্য কোনো অনুদান। ভোটের অধিকার পেলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের নিয়ে কোনো চিন্তা করেন না। শুধু ভোটের সময় এলে তাদের নানা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন।

শহরের নতুন বাবুপাড়া এলাকার হরিজনপল্লির আলো রানী স্যানিটেশনর কাজ ও সংসার দু’টো সামলাতে গভীর রাতে অনেকটা জনমানবশূন্য ফাঁকা রাস্তায় ঝাড়ু দেন। তিনি বলেন, কোথাও মধ্যরাতে, কোথাও শেষ রাতে ঝেড়েমুছে সড়কগুলোকে মানুষের চলাচলের  জন্য উপযোগী করে তুলতে হয়। নিভৃত সেই কর্মপরিবেশ। সে সময় স্থানীয় নানা অপরাধীর মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১২ বছর ধরে তিনি এ কাজ করে আসছেন। আগে তাঁর বেতন ছিল ২,৪০০ টাকা। এখন তিন হাজার টাকা হয়েছে। আবার কোনোদিন অনুপস্থিত হলে ১০০ টাকা বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়।

শুভ বাসফোর নামে আরেকজন স্যানিটেশন কর্মী বলেন, তাদের পেশা বাদে সব পেশার মানুষদের যে হারে বেতন-ভাতা বেড়েছে, সেই অনুপাতে তাদের বাড়েনি। এখনও যারা শহরে ঝাড়ু দেয় তাদের বেতন ২,২০০ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। মানববর্জ্য অপসারণ ও ড্রেন পরিষ্কার যারা করেন তাদের বেতন ৩,৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা। এ অল্প বেতনে তাদের মাসে দশ দিনের সংসার খরচের জোগান হয় না। ফলে খেয়ে-না খেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। এছাড়া সামনের দিনগুলো ভালো আসবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

মুন্সিপাড়া হরিজনপল্লির মিথুন বাসফোর জানান, তাদের নির্দিষ্ট কোনো পোশাক ও নিরাপত্তার জন্য কোনো সরঞ্জাম দেওয়া হয় না। অনেক সময় বাসা-বাড়ি থেকে আবর্জনা সংগ্রহের সময় কাঁচের টুকরা বা ব্লেড থেকে হাত কেটে রক্তাক্ত হয়েছে। কেন এভাবে কাচের টুকরা বা ব্লেড ফেলে রেখেছেন বাড়ির লোকজনকে এমন প্রশ্ন করলে, উল্টো তারা রাগ দেখান। এমনকি অনেক সময় তারা গায়ে হাত দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে তাদের লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে।

রসুলপুরের রিপন বাসফোর অভিযোগ করে বলেন, মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে তাদের সহাবস্থান। এতে করে তাদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। তারা যে পশু (শূকর) পালন করেন, মুসলমানরা তাতে বাধা দেন। একারণে তাদের সঙ্গে হামলা-মামলা পর্যন্ত হয়েছে। তাদের যদি শহর থেকে দুরে আলাদা একটি পল্লি করে দিলে ভালো হতো বলে মনে করেন তিনি।

পৌরসভার স্যানিটেশন কর্মীদের সুপাভাইজার হাসান আলী রবি বলেন, তাদের জীবনমান উন্নয়নে বেসরকারি অনেক এনজিও এখন কাজ করছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এসকেএস ফাউন্ডেশন। এ প্রতিষ্ঠানটি হরিজনদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এতে করে তাদের জীবন দক্ষতা বাড়ছে।

হরিজনদের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে সৈয়দপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক আরিফুল ইসলাম বলেন, দলিত হরিজনরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা তেমন পায় না। এখন সবকিছুতে পরিবর্তন আসছে। তাই সরকারের উচিত দলিত-হরিজনদের জন্য আলাদা একটি কমিশন গঠন করা। এ কমিশনের প্রথম কাজ হবে সমাজে তাদের সম্মান প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া আবাসন, চাকরির অধিকার নিশ্চিত করে তাদের বিকাশের পথ যেভাবে সুগম হয় তা নিশ্চিত করা।

সৈয়দপুর নাগরিক অধিকার পরিষদের আহবায়ক দেলোয়ার হোসেন ভাভিস্কো বলেন, দলিত-হরিজনরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। তাদের এখনও আধুনিক সমাজে কোনো মর্যাদা নেই। মৌলিক অধিকার থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করানো, তাদের হোটেলের বাইরে বসে খেতে দেওয়া, এমন সব মধ্যযুগীয় ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে তারা প্রতিনিয়ত। রোহিঙ্গা কিংবা অবাঙালিদের এদেশে বিশেষ সুবিধায় পুনর্বাসন করা হলেও তাদের জন্য কোনো উদ্যোগই নেওয়া হচ্ছে না। বর্তমানে তাদের পেশায় সরকারিভাবে এখন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষেরাও আসছেন। ফলে পেশাগত প্রতিযোগিতা আরও বাড়ছে।

আরও পড়ুন

×