কালের যাত্রা ২০২৫
নারী: ২০২৫ সালের ভাবনা

সামিনা লুৎফা
সামিনা লুৎফা
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৩৬ | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৭:৩০
‘২০২৪’ এমন এক নাম, যাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না! তবে স্বৈরাচার হটানোর এই বিশেষ বছরটিতে আমাদের সব ক্ষেত্রে এত ভালো ফলাফল নেই। বিশেষত, নারীর বিরুদ্ধে নানাবিধ শারীরিক, মানসিক, যৌন সহিংসতা বন্ধ হয়নি, নারীর কাজের অধিকার, চলাচলের অধিকার, সমান কাজে সমান মজুরির অধিকার, বিয়েবিচ্ছেদ এবং অভিভাবকত্বের অধিকার এখনও মেলেনি। নারীর সন্তান উৎপাদন, গৃহস্থালি কাজের চাপ, বাইরে কাজের সমমর্যাদা, সর্বোপরি নারী-পুরুষের সমান অধিকার এখনও ভাগ্যে জোটেনি।
গত নভেম্বরে পুলিশ সদরদপ্তরের বরাতে নাজনীন আখতারের (প্রথম আলো, ৯ নভেম্বর ২০২৪) প্রতিবেদনে জানা যায়, এ বছরে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর বিভিন্ন ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার অর্ধেক ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে (ধর্ষণের অভিযোগে ৪ হাজার ৩৩২টি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ১ হাজার ৮৭০টি) করা হয়েছে। যেসব কারণের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে যৌতুকের জন্য নির্যাতন (৩ হাজার ২০৮টি), দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ (৪৭টি), অপহরণ (৩ হাজার ২৮৭) এবং শিশু পণবন্দি করা (২৫টি) রয়েছে। অন্য আরেক গবেষণা থেকে জানতে পারি, বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার নারীর মাত্র শতকরা ১ ভাগ পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে যান। অভিযোগ না জানানোর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, সামাজিকভাবে কলঙ্কিতকরণ, পারিবারিক বাধা ইত্যাদি। যেমন ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন বলছে, স্বামীর হাতে হওয়া নির্যাতন ও হত্যার তথ্য অনেক কম জানা যায়। তথ্য পাওয়া যায়নি মানে কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতার হার গত কয়েক বছরে কমেনি এমন না; বরং ভবিষ্যতে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেহেতু নারীরা এখন লেখাপড়া করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চাইছে, বা অধিকার ও মতামত প্রকাশে সচেতন হয়ে উঠছে, কাজেই যারা আওয়াজ তুলছে, তারা নারীর ‘ঐতিহ্যবাহী নিঃশব্দ’ ভূমিকার কর্তাসত্তাহীন উদযাপনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। তাদের এই স্বাধীনতা পুরুষের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে বলে পুরুষের ‘ক্ষমতা হারানোর’ শঙ্কা সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীর শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুঁজির মালিক সস্তায় নতুন শ্রমিক জন্ম দেওয়া, পুরোনো শ্রমিকের কাজের ভার নারী দেহের ওপর ন্যস্ত রাখা বা নারীকেই সস্তা শ্রমিক বানিয়ে পুঁজি শোষণের মূল ব্যবস্থা চালু রাখে। ফলে নারীর দেহ পুরুষের কবজায় থাকে, নারীর নিজ স্বর সে নিজেই শুনতে ভুলে যায়। পিতৃতন্ত্র আর পুঁজিবাদ মিলেমিশে নারীকে এক ভোগযোগ্য, সস্তায় শ্রম উৎপাদনে পারদর্শী বস্তু বা পণ্য বা সম্পত্তি হিসেবে দেখে বলে নারী তার নিজের আওয়াজ ওঠাতে পারে না, ভগিনীরা জেগে ওঠে না। শৃঙ্খলে তারা মর্যাদা দেখে এবং দরিদ্র নারীর চাইতে বেশি অধিকারের মায়ায় তারা মজে থাকে বলে পুরুষ দুনিয়ার নারীবিদ্বেষ তার নিজের দোষে প্রাপ্ত শাস্তি বলে মনে হয়। নারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাই, নীতিনির্ধারণে তাঁর আওয়াজ ক্ষীণ, নির্ধারকের টেবিলে তাঁকে জায়গা দেওয়া হয় না, আর জায়গা নিতে পুরুষালি ধাক্কাধাক্কিতে যেতে গেলে তাঁকে গাল খেতে হয় সহজলভ্য ‘পতিতা’ বলে, বা শিকার হতে হয় ভাষিক বা শারীরিক যৌন নিপীড়নের।
এ তো গেল নির্যাতনের বর্ণনা, নির্যাতনের শিকার নন এমন নারীরাও এ দেশে ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার। সমকাজে সমবেতন নাই, প্রশিক্ষণ, অন্যান্য সুবিধায় তাদের নাম লিস্টের নিচে থাকে, বিয়ে এবং বিচ্ছেদে, অভিভাবকত্বে সবকিছুই পুরুষের অধিকারে থাকে। তবে জুলাই অভ্যুত্থান যা ৩৬শে জুলাই (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আমরা নতুন ইউটোপিয়ায় প্রবেশ করি। এও এক কল্পনার জগৎ, কারণ বৈষম্যহীনতার নামে যার উদযাপন দেখি সেখানে নারী রয়ে যায় অন্ত্যজ। তার বিরুদ্ধে যেন অস্ত্রে দেওয়া হয় নতুন শান। যদিও এবারের অভ্যুত্থানে নারী, ভিন্ন ধর্ম ও জাতিসত্তা এবং প্রান্তিক বা নন-বাইনারি লিঙ্গপরিচয়ের মানুষসহ সব ধরনের জনগণকে জোরালো ভূমিকায় দেখা গেছে তবুও ৩৬শে জুলাই-এর পর সেই ভিন্নতা বা বৈচিত্র্যের অবদানকে খুব বেশি উদযাপন করতে আমরা দেখিনি। যদি শুধু নারীর অবস্থার দিকেও তাকাই, তবে আন্দোলনের পর আমরা নারীর একটা অধস্তন জায়গায় দেখলাম; যেন বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে তাদের কথা বা অবদান উল্লিখিত হয়। উদযাপনে তারা নাই, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা নাই, তারা কেবল যেন রাতের বেলা হলের তালা ভেঙ্গে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে বা লাঠি টিয়ার বুলেট উপেক্ষা করে রাস্তায় আন্দোলনে, মিছিলে সামনে থেকে, পুলিশের হাত থেকে আন্দোলনকারীদের উদ্ধার করে বা ডিবি অফিসে আটক থেকে আন্দোলন চাঙ্গা রেখে আবার ফিরে গিয়েছে আড়ালে। যদি সে বের হয় তাহলে সেই নতুন শান দেওয়া পুরোনো অস্ত্র তাক করা হয় তার দিকে– চরিত্র হনন, জবরদস্তি, নতুন নিপীড়ন বা পুরোনোগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে নিপীড়ক পুনর্বাসন করার সুযোগ করে দেওয়া, ইত্যাদি!
আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের মধ্যে যারা নারী তাদের তেমন দেখতেও পাই না জনপরিসরে বা চলমান জ্ঞান/তত্ত্ব বিস্ফোরণমূলক আলোচনা সভার সিরিজ বা সংস্কার কমিশনগুলোতে। এমনকি উপদেষ্টা পরিযদও পরিণত হয়ে আছে কয়েকজন আলংকারিক নারীসহ একটা বয়সভিত্তিক বয়েজ ক্লাবে, যত বড় হচ্ছে তত নারীর প্রতি বঞ্চনা দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রবল পুরুষালি ধাক্কা ও ধমকে ‘দায় ও দরদের’ রাজনীতি; বরং ধর্মীয়, লিঙ্গীয়, সাংস্কৃতিক, জাতিগত বা ধর্মের বিভিন্ন ফেরকার তফাত দিয়ে মানুষকে বিভাজিত করছে। প্রান্তিক বর্গগুলোর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সহিংসতা চলার পর বিশেষত নারী ও সংখ্যালঘুকৃত জনগোষ্ঠীর জন্য দেশ অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু পরিত্রাণের উপায় কী? প্রথমত. নারী ও প্রান্তিকের স্বরকে হাওয়া করে দেওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে সারাক্ষণ উচ্চকিত থাকতে হবে, সব বয়ান তৈরিতে প্রান্তিক স্বরের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের সাফল্য, অর্জন ও অংশগ্রহণকে উদযাপন করতে হবে।
দ্বিতীয়ত. দেশের রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের নেতৃত্বে, মনোনয়নে ও প্রতিনিধিত্বে নারী ও প্রান্তিকের উপস্থিতি ও প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। আগামী এক বছরে যেসব রাজনৈতিক দল তাদের নারী নেতৃত্বকে আমাদের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হবে তারা নির্বাচনে নারী ভোটারদের পাশে পাবে না। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন করতে হবে, ক্রমান্বয়ে নারী সাংসদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। জনসংখ্যায় নারীর অনুপাতে সংসদে নারী সদস্যদের নির্বাচিত করে আনা গেলে কিছুটা পরিবর্তন সম্ভব হবে।
তৃতীয়ত. সব লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, শিক্ষালয়, রাস্তা, জনপরিসর তৈরি করায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যে কোনো নিপীড়ন বিশেষত যৌন নিপীড়ন মোকাবিলায় আইন প্রণয়ন করতে হবে, ইতোমধ্যে হওয়া মামলার দ্রুত শুনানি ও বিচার করতে হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের নিবর্তনমূলক কোনো ধারা অটুট রাখা যাবে না। স্বাধীন কমিশন গঠন করে সাইবার জগতে নারীকে সুরক্ষা দিতে হবে।
চতুর্থত. মজুরি, পদমর্যাদা এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে হবে, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, যাতায়াত ও জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে, সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মক্ষেত্রে ও আবাসিক এলাকায় পার্ক, খেলার মাঠ, জাদুঘর ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে হবে।
পঞ্চমত. পারিবারিক সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারের সমানাধিকার, বিয়েবিচ্ছেদ এবং অভিভাবকত্ব ও লালনপালনে সমান অধিকার ও দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
ষষ্ঠত. নারীর নিজের শরীর, জীবন-জীবিকা নির্বাচনে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাধা অপসারণ করতে হবে। শিশু বয়স থেকে সমতার ধারণা পারিবারিক ও বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শেখাতে হবে, বাল্যবিয়ে বন্ধ করে মেয়েশিশুদের শিক্ষা থেকে ঝরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে।
সপ্তমত. নারীর শিক্ষায় ভালো ফলাফল কেন কর্মক্ষেত্রে তার অর্জনে এবং পদোন্নতিতে প্রতিফলিত হয় না; বরং শিক্ষিত নারী কেন কর্মক্ষেত্রে ঝরে যায় তা সমাধানে কাজ করতে হবে।
অষ্টমত. নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, যেন নারীর জন্য প্রতিবেশ নিরাপদ আর মর্যাদাপূর্ণ হয়।
নবমত. নারীর জন্য সরকার পরিচালনের বাজেট পৃথকভাবে বরাদ্দ করতে হবে এবং সম্পত্তি ও সম্পদে (উত্তরাধিকারসূত্রে এবং স্বোপার্জিত) নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বাধা অপসারণে কাজ করতে হবে সরকারকে। ব্যবসায় নারীর অভিগম্যতা বৃদ্ধি, সরকারি চাকরিতে তাদের শতকরা হার বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ, যা অর্জন ছাড়া আগামী এক বছর নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অর্ধেক হয়ে থাকবে।
সবশেষে, এমন কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা করা যাবে না, যা পরিবেশ ও প্রকৃতি, বন-সবুজ পরিসরকে সংকুচিত করে, শিশুদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে ও নারীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- নারী
- নারীর ক্ষমতায়ন
- নারীর প্রতি সহিংসতা