ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার বিকল্প নেই

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার বিকল্প নেই

যতীন সরকার

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০

'সমকাল' নামক সংবাদপত্রটির সঙ্গে আমি এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই পাঠক হিসেবে যুক্ত। বর্তমানে অসুস্থ হয়ে নেত্রকোনায় গৃহবন্দি অবস্থায় আছি, তবুও সমকালের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারি না। ২০১৭ সালে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করে প্রতিষ্ঠানটি আমাকে সম্মানিত করেছে। সমকালের ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পত্রিকাটির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সকলকে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।
সমকাল এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্লোগান নির্ধারণ করেছে 'বাংলাদেশের হৃদয় হতে'। আমাদের যে রাষ্ট্রটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনগণের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। অবশ্যই আমরা যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন দেশের পত্তন করেছি। কিন্তু যুদ্ধ তো প্রথম থেকেই শুরু হয়ে যায় নাই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছিল স্বাধীন দেশ গড়ার সূচনা, যাকে বলব সাংস্কৃতিক আন্দোলন; সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা রবীন্দ্র বিরোধীতাকে রুখে দিতে পেরেছি, নজরুলের খণ্ডায়নকে রুখে দিতে পেরেছি, বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে যে সংহারের অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল তা দূর করতে পেরেছি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তার মধ্য দিয়েই একটা সময় 'বাংলাদেশ' একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি রাষ্ট্র। এ জন্য বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে অবদান, সে জন্য আজকের দিনে তার কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি।
আমরা আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি দলিল তথা সংবিধান তৈরি করেছিলাম। সংবিধানের মূলনীতি ছিল চারটি- 'গণতন্ত্র', 'ধর্মনিরপেক্ষতা', 'জাতীয়তাবাদ' এবং 'সমাজতন্ত্র'। এ চারটি মূলনীতির সমন্বয়েই আমাদের দেশ অগ্রসর হবে, এমনই ছিল আমাদের কামনা। কিছুটা অগ্রসর হয়েও ছিল। কিন্তু একটা বিষয় আমরা ভুল করেছিলাম, আমাদের ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না, সেটা হলো- আমরা মনে করেছিলাম, আমরা তো স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছি, সেটা বোধহয় আপনা-আপনি থেকে যাবে। স্বাধীনতাবিরোধীরা যারা সর্বত চেষ্টা করেছিল স্বাধীনতাকে রুখে দিতে, স্বাধীনতার পরও কিন্তু থেমে থাকে নাই। নানা গোপন চক্রান্তের মধ্য দিয়ে তারা সক্রিয় ছিল। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করে। যার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে আমাদের রাষ্ট্রকে উল্টো পথে নিয়ে গেল তারা। আমি বলি এই অপশক্তি 'পাকিস্তানের ভূত'কে নিয়ে এসেছে। ১৯৭৫ সাল পরবর্তী যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেই ঘটনাগুলো পাকিস্তানের ভূতের দ্বারাই ঘটছে বলে আমি বিশ্বাস করি। যে কারণে আমি 'পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যুর দর্শন'-এর পরে আমি একটি গ্রন্থ রচনা করতে বাধ্য হয়েছি 'পাকিস্তানের ভূতদর্শন' নাম দিয়ে।
পাকিস্তানের ভূতের আছর থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। বলা হয়ে থাকে, ভূতের পা হলো পিছন দিকে, এই ভূতও আমাদের পিছন দিকে নিয়ে যেতে চায়। কাজেই ভূতের আছর থেকে মুক্তি পেতে হলে কী করতে হবে, পেছনে চলে যাওয়া থেকে আমাদের সামনের দিকে আসতে হবে। প্রশ্ন হলো এই দায়িত্ব কার, দায়িত্ব হলো সেই জনগণের, যে জনগণ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গিয়েছি। এখন যদি সত্যিকার অর্থে পাকিস্তানের ভূতকে দূর করতে হয়, তাহলে অবশ্য অবশ্যই আমাদের নতুনভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করতে হবে।
এবারের দুর্গাপূজায় কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, যার সূত্রপাতে দেশজুড়ে যেসব ঘটনা ঘটে গেল, তা দেখে মনে হচ্ছে 'পাকিস্তানের ভূত' এখন অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং এই ঘটনা নানাভাবে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের প্রচার-প্রসারেরও ইঙ্গিত বহন করছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি না পেলে, আমাদের বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা, সেটা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে। এই ব্যর্থতার হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে, আগেও বলেছি এখনও বলছি, আমাদের আবারও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করার কোনো বিকল্প নেই।
ধর্মতন্ত্রের মৌলবাদকে প্রতিহত করে আমরা যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, আমাদের ভুলের দরুন, আমাদের অসচেতনতার সুযোগে ধর্মতন্ত্রের পক্ষপাতের লোকগুলো তথা ভূতেরা আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসতে পারে, তা আমরা কখনও ধারণাই করি নাই। কাজেই এই মুহূর্তে যে সকল ঘটনা ঘটছে এতে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, আমাদের দেশটি যাতে কোনোভাবেই অসাম্প্রদায়িক না থাকে এ জন্য সমস্ত সাম্প্রদায়িক শক্তি আজ একত্র হয়েছে। সেই সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের স্বাধীনতার যে মূল মর্ম, সেটি অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এই যে সাম্প্রদায়িকতা, এই যে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ- এসবের বিরুদ্ধে যদি আমরা নতুন করে না দাঁড়াতে পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ হবে খুবই অন্ধকার। কিন্তু আমি সব সময়ই আশাবাদী, 'অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো হবে ভবিষ্যত', এটা আমি সবসময় মনে করি। আমাদের যে বর্তমান প্রজন্ম এদের কাছে সমস্ত বিষয়গুলো তুলে ধরা উচিত। তারা বর্তমানে ইতিহাসের ব্যাপারে অনেক অজ্ঞ বলে মনে করি, কারণ প্রকৃত ইতিহাস কখনও তাদের কাছে তুলে ধরা হয় নাই। প্রজন্মের নিকট ইতিহাস তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদের সবার। এবং এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলো একটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।
ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষের প্রকৃত ধর্ম প্রতিষ্ঠায় আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। যে কাজটি আমরা এখনও করতে পারি নাই। প্রশ্নাতীতভাবে এ কাজ এখন করে যেতে হবে। দৈনিক সমকাল এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করি। যার মাধ্যমে একটা প্রবল গণআন্দোলন তথা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠবে। যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা পাকিস্তানের ভূতকে তাড়াতে পারব।
লেখক

শিক্ষাবিদ
প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন

×