সাক্ষাৎকারে হাফিজ উদ্দিন আহমদ
মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকারের দুঃসাহস কেউ দেখাবে না

হাফিজ উদ্দিন আহমদ
কামরুল হাসান
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৩ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫:৪৫
যারা বিপ্লবকে ধারণ করে, যারা এই শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তাদেরই ন্যায্য অধিকার রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার দুঃসাহস কেউ দেখাবে না বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম। তিনি বলেন, পরাজিত শক্তিগুলো বিভিন্ন সময়ে একাত্তরের স্মৃতিকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে। অথচ একাত্তরের যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এতে পুরো জাতি অংশগ্রহণ করেছিল। সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল হাসান
সমকাল: স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্ণ হলো। দেশ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে?
হাফিজ উদ্দিন আহমদ : অধিকাংশই পূরণ হয়নি। আমরা একটি ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার যে মূল লক্ষ্য– সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ইত্যাদি মোটেও অর্জিত হয়নি। বিশেষ করে গত ১৬ বছরে বাংলাদেশকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে গুম, খুন করেছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছে। অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যা কিছু ছিল, তার বিপরীতে ছিল দুর্বৃত্ত দলটি। যে আদর্শ ধারণ করে আমরা যুদ্ধ করেছি, সেটি আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের কারণে সফল হয়নি।
সমকাল: প্রত্যাশা পূরণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
হাফিজ উদ্দিন আহমদ: আজ দেশে গণতন্ত্র নেই। এখন একটি অন্তর্বর্তী সরকার আছে। আশা করব, তারা দ্রুত একটি সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করবে এবং আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে সমাজ-দেহে যেসব ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো নিরাময় করবে। তবে এসব সংস্কারের দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। বিএনপি ১৭ বছর ধরে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে, সেই আন্দোলনের সমর্থনে যারা একটি বাক্য উচ্চারণ করেনি, তারা এখন সরকারে অধিষ্ঠিত। যারা বিপ্লবকে ধারণ করে, যারা এই শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তাদেরই ন্যায্য অধিকার রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার। আমরা দুই বছর আগেই ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেছি। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সমকাল: মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসহ সাধারণ মানুষের সাহসী লড়াই নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
হাফিজ উদ্দিন আহমদ: সাধারণত নতুনদের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এক বছর ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। আমরা দেড় মাসের মধ্যে যুদ্ধে আগত ছাত্র-জনতাকে রাইফেল ও মেশিনগান চালানো শিখালাম। দেড় মাস পরেই এই ছাত্ররা দুঃসাহসী যোদ্ধায় পরিণত হয়। আমাদের বড় অপারেশন হলো শেরপুর জেলার কামালপুরে। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী শক্তিশালী ঘাঁটি বসিয়েছিল। ২০০ সৈনিক নিয়ে এদের আক্রমণ করি। দেড় মাস ট্রেনিং নেওয়া ছাত্রদের নিয়ে আমরা ভয়াবহ একটি আক্রমণে যাই। মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় এবং প্রথাগত আক্রমণ। আমাদের ২০০ জনের মধ্যে ১০০ জন হতাহত হয়। আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ হন। আমরা এত হতাহতের কারণে ঘাঁটির কিছু অংশ দখল করার পর পিছিয়ে আসতে বাধ্য হই। নিয়মিত সেনাবাহিনী অবাক হয়ে যায় এই যুদ্ধে তরুণদের অসীম সাহসিকতায়।
সমকাল: স্বাধীনতার যুদ্ধ সফল হলো কীভাবে?
হাফিজ উদ্দিন আহমদ: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সাধারণ মানুষের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ছাত্র, যুবক, কৃষক, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা, ইপিআরের সৈনিকরা যে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তার জন্য আমরা খুবই গর্বিত। স্বাধীনতা যুদ্ধ সফল হয়েছে এই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের ফলে। রাজনৈতিক দলগুলো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের কথা তারা চিন্তাও করেনি। তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যস্ত ছিল। তারা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। সে ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হতেই পারেন। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ এক নতুন অধ্যায়, এক সশস্ত্র অধ্যায়। মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অনেক প্রাণ বিসর্জনের ফলেই দেশ স্বাধীন হয়েছে।
সমকল: প্রত্যেক সরকারের আমলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ শোনা যায়...
হাফিজ উদ্দিন আহমদ: যুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার। অথচ এখন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাচ্ছে ২ লাখ ৮ হাজার। এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। আওয়ামী লীগ আমলের ১৬ জন সচিব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা নিয়েছিলেন। অথচ যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১২ বছর। এ রকম অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ সরকার সৃষ্টি করেছিল।
সমকাল: প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কীভাবে সম্ভব হবে?
হাফিজ উদ্দিন আহমদ: এটি খুবই সহজ। একটি তালিকা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আছে। যেটা ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা যুদ্ধের পর দিয়েছিল। ওই তালিকার প্রত্যেকেই মুক্তিযোদ্ধা। যেখানে ৮০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা রয়েছে। এর বাইরে দেশের মধ্যে কিছু লোক বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ করেছে। এ রকম আরও ২০ হাজার হতে পারে। সব মিলিয়ে ১ লাখ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা এখনও করা সম্ভব।
সমকাল: বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরিতে উদ্যোগ গ্রহণ করবে?
হাফিজ উদ্দিন আহমদ: বিএনপির আমলেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গঠন হয়েছিল। সুতরাং বিএনপিই পারবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা করতে। জনগণ যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়, তাহলে নিখুঁত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সমকাল: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ আর ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান। একটি পক্ষ ৫ আগস্টকে দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছে। এ নিয়ে সাংঘর্ষিক অবস্থা হবে?
হাফিজ উদ্দিন আহমদ: এখন পর্যন্ত সাংঘর্ষিক অবস্থা নেই। তবে ১৯৭১ সালে অনেক সক্ষম ব্যক্তিও মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়ে গেছেন। সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। তারা হলেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী। তারা কোনো সময়ে কোনো সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন না। কিন্তু ফায়দা নেওয়ার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। এখন সময় হয়েছে তাদের মুক্তিযোদ্ধা সাজার। এজন্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলার চেষ্টা করছে। তারা একাত্তরের স্মৃতিকে ভুলিয়ে দিতে চায়। অথচ, একাত্তরের যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধে পুরো জাতি অংশগ্রহণ করেছিল। আর এবার ফ্যাসিবাদমুক্ত করার আন্দোলনে বিএনপিসহ ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছিল। অনেক রাজনৈতিক দলই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে অংশ নেয়নি। এখন তারাই নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করছে। তাদের একটি অংশ এখন সরকারে আছে। তাদের কথাতেই মাঝেমধ্যে সাংঘর্ষিক মনে হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার দুঃসাহস কেউ দেখাবে না। জনগণও এটিকে গ্রহণ করবে না। এ দেশ ’৭১ সালেই স্বাধীন হয়েছে। গত ৫৩ বছরে অনেক সময়ে অনেক দুঃশাসন দেশকে গ্রাস করেছিল। দুঃশাসন থেকে বের হয়ে কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে উদ্যোগ গ্রহণ করব। সুতরাং, সেটাই হোক আমাদের লক্ষ্য।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ
হাফিজ উদ্দিন আহমদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।
- বিষয় :
- বিজয়ের মাস
- বিজয় দিবস