সোনালি অধ্যায়ের সম্পর্কে ছিল চরম বৈষম্য
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক পরস্পরের জন্য লাভজনক করার সুযোগ

কোলাজ
তাসনিম মহসিন
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:২৩
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ভারতের সমর্থন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা এবং গণতন্ত্রকে ‘হত্যা’ করে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকার নেপথ্যে ভারতের ‘স্বার্থের হাত’ আছে বলেই মনে করা হয়। ‘সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়’ টিকিয়ে রাখতে গিয়ে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র উন্নয়ন, সুশাসন দূরে সরিয়ে রেখে বাংলাদেশ নতজানু কূটনৈতিক সম্পর্কের দিকেই ঝুঁকে ছিল। ভারতের স্বার্থ দেখতে গিয়ে অন্য দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে ৫ আগস্টের পর দুই দেশের সামনে সুযোগ তৈরি হয়েছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একে অপরের জন্য লাভজনক করার।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একশর ওপর চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও নথি সই হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় এমন কোনো খাত নেই, যাতে ভারতের সম্পৃক্ততা নেই। হাসিনা আমলে দুই দেশের সরকারপ্রধানদের একাধিক সফর ও বৈঠক, প্রায় প্রতি মাসে কর্মকর্তা পর্যায়ের কোনো না কোনো বৈঠক, দুই দেশ একত্রে দেশে দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন বা প্রতিটি সুযোগে দুই দেশের মৈত্রী এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা মনে করিয়েছে।
তবে এত কিছুর পরও সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা ও গুমের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকা, অভ্যন্তরীণ স্পর্শকাতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ, পররাষ্ট্রনীতিতে দিল্লির সুবিধা করে দেওয়া, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেওয়া এবং শেখ হাসিনাকে লৌহমানবী হিসেবে তৈরি করার পেছনে ভারতকে সরাসরি দায়ী করা হয়। যার ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধিতা তুঙ্গে।
ঢাকা দিল্লিকে অনুসরণ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গতিতে একটা গতিরোধক স্থাপন করে বলে বিশ্লেষণ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের পূর্ণ উপযোগিতা ব্যবহার করতে পারেনি ঢাকা। সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে দেশের অগ্রগতি আরও টেকসই হতে পারত। তবে পররাষ্ট্রনীতিতে দিল্লিকে সুবিধা করে দিতে গিয়ে সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি ঢাকা।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন সফলভাবে পার করতে পেরেছিলেন দিল্লির বদৌলতে। ভোটের আগমুহূর্তে দেশটির তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে প্রয়াত এইচ এম এরশাদকে বাধ্য করেছিলেন নির্বাচনে অংশ নিতে। সেই থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ক্ষয় শুরু হয়। এ ছাড়া সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কিছু করতে গেলেও ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। যার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ গঙ্গা, তিস্তা, সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দর বা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো প্রকল্পগুলো। আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তিসহ ভারতের সঙ্গে ঋণচুক্তিগুলো তো রয়েছেই, যাতে বাংলাদেশের যতটা না লাভ, তাতে ভারতের লাভ বেশি।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৩২ হাজার কোটি টাকার গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পে যুক্ত হতে চেয়েছিল জাপান। জলবিদ্যুৎ, শুষ্ক মৌসুমে পানির সমস্যা নিরসন, নদীর পানি সংরক্ষণ, শাখা নদীগুলোর উন্নয়নসহ সার্বিক দৃষ্টিকোণে দক্ষিণে লবণাক্ততা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারত প্রকল্পটি। তবে প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৭ সালের এপ্রিলে ভারত ঘুরে এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, গঙ্গা ব্যারাজের যে নকশা তৈরি করেছে, সেটি ভুল। সেটি নেওয়া হলে আমাদের জন্য আত্মঘাতী হতো। আর সে কারণেই আমি প্রকল্পটি নাকচ করে দিয়েছি। এ রকম কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সঙ্গে যৌথভাবেই করতে হবে।
এদিকে ভারত থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা না পেয়ে ২০১৬ সালে তিস্তা প্রকল্পে চীনের সহায়তা চেয়েছিল বাংলাদেশ। তার পরিপ্রেক্ষিতে চীন যখন প্রকল্পের আর্থিক কারিগরি সহায়তা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন এ-সংক্রান্ত নতুন প্রস্তাব নিয়ে সামনে আসে ভারত। ফলে প্রকল্পটি নিয়ে চীন আর এগোতে পারেনি।
চলতি বছরের জুলাইতে চীন সফর থেকে ফিরে এ প্রকল্প নিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিস্তা নিয়ে চীন-ভারত দুই দেশই প্রস্তাব দিয়েছিল। এরই মধ্যে চীন সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও সম্ভাব্যতা যাচাই করবে। দুই দেশের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে আমাদের জন্য যেটি যুক্তিযুক্ত হবে, আমরা সেটি নেব। তবে এখানে বেশি প্রাধান্য দেবে যে এটি ভারত করুক।
সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে চুক্তি করার সব প্রস্তুতি নিয়েছিল বাংলাদেশ। আর এটি সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে এ থেকে সরে আসে ঢাকা। বাংলাদেশ রাশিয়ার সহযোগিতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে– এমন কৌশলগত দ্বিপক্ষীয় প্রকল্পেও রয়েছে ভারত।
বিগত সময়গুলোতে বাংলাদেশের বেশির ভাগ সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দু ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং দিল্লিকে সন্তুষ্ট রাখা। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে ঢাকা। দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেয়নি এবং তাদের গ্রেপ্তার করে দিল্লির হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য পরিবহনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশ ভারতকে নামমাত্র মূল্যে পূর্ণ ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট দিলেও বাংলাদেশ এখনও ভারত থেকে এ সুবিধা পায়নি। বিভিন্ন দিক থেকে সম্পর্কে বৈষম্যের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। তবে সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি ভারত থেকে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ডিসেম্বরে দ্বিপক্ষীয় ফরেন অফিস কনসালটেশনের পর পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কে বিশ্বাসের একটি ঘাটতি রয়েছে। সমস্যাকে স্বীকার করে নিলে তা কাটিয়ে ওঠা যায়। দুই দেশের বৈঠকটি হচ্ছে বিশ্বাসের ঘাটতি মেটানোর একটি পদক্ষেপ। এ পথকে অনুসরণ করে পরবর্তী স্তরে আলোচনার প্রত্যাশা করেন তিনি।
আর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। গত সপ্তাহে কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন, চারদিকে পরিবর্তন ঘটলেও দুই দেশ সত্যিই একে অপরকে এমন কিছু দিতে পারে, যা পেতে তাদের অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। ভারত সম্পর্কটি এভাবেই দেখে।
গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে জানিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এই সম্পর্কের দিকে তাকাচ্ছি। এখানে দুই দেশের সম্পর্ককে পরস্পরের স্বার্থ, উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে বিবেচনা করতে হবে। চারপাশের পরিবর্তন সত্ত্বেও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মৌলিক বিষয়গুলো এগিয়ে নিতে যা যা করা দরকার, দিল্লির পক্ষ থেকে সেসব করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, সম্পর্কটি অবশ্যই পরস্পরের জন্য লাভজনক হতে হবে। (দুই দেশের) জনগণই এ সম্পর্কের মূল অংশীজন। আমরা বিশ্বাস করি, সহযোগিতামূলক সম্পর্ক উভয় দেশের সাধারণ মানুষের জন্যই কল্যাণকর হবে।
কূটনীতিকরা বলছেন, বিগত সময়ে দুই দেশের সম্পর্ককে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, এখন সুযোগ তৈরি হয়েছে সম্পর্ককে জনগণবান্ধব করে একে অপরের জন্য লাভজনক করার।
- বিষয় :
- বৈষম্য