ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার

‘এখন কেউ হিজড়া ডাকে না, বলে চেয়ারম্যান সাহেব’

‘এখন কেউ হিজড়া ডাকে না, বলে চেয়ারম্যান সাহেব’

নজরুল ইসলাম ঋতু

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৩ | ১১:২৮ | আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৩ | ১৪:৪৯

দেড় বছর আগে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ত্রিলোচানপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু। জনগণের ভোটে তিনিই প্রথম দেশের তৃতীয় লিঙ্গের ইউপি চেয়ারম্যান। এই পথচলার গল্পটা সহজ ছিল না তার জন্য। সংগ্রামী জীবনের দিনগুলো কীভাবে কাটাচ্ছেন, কেমন চলছে জনপ্রতিনিধিত্ব, সেসব নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মামুন সোহাগ। 

সমকাল: কেমন আছেন? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: বেশ ভালো আছি। এখন অনেক ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি।

সমকাল: ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার দেড় বছর পার হয়েছে। এই পথচলা কেমন? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার পর দেড় বছরের বেশি সময় কেটে গেছে। সময়টা খুব বেশি না। থাকতে হবে পাঁচ বছর। এই ইউনিয়নে অনেক কাজ। নির্বাচিত হওয়ার আগে সেটা বুঝতে পারিনি। সরকার আমাদের অনেক কাজ দিচ্ছে। যতটুকু কাজ করতে হবে, যতটা উন্নয়ন করতে চাই, সেটা আমি করতে পারছি না। মাঝেমধ্যে মনে করি, জনগণের আশা পূরণ করতে পারছি না। তাই প্রাণপণে চেষ্টা করছি জণগণের জন্য কিছু করার। 

সমকাল: আপনি কাজ করতে গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়ছেন কি? কিংবা কোনো বাধা 


নজরুল ইসলাম ঋতু: এখানে ৫০ বছর আগে যে সমস্যাগুলো ছিল সেগুলো আমাকে সমাধান করতে হচ্ছে। আগে সেভাবে কাজ করেননি তারা। এই ইউনিয়নে যত কাজ আছে সেই কাজগুলো করতে হলে আরও সময় দরকার। হুট করে চেয়ারম্যান হয়েই সব সমস্যা সমাধান করতে পারব না। আমিও সেটা পারছি না। 

সমকাল: ইউনিয়নের উন্নয়নের জন্য কোন কাজকে প্রাধান্য দিচ্ছেন? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: আমি যেহেতু এখন এই এলাকার চেয়ারম্যান সেহেতু সবকিছুই আমার দেখতে হচ্ছে। আমি নারী ও শিশুদের সব ধরনের সহযোগিতা করব যা শুরু থেকেই বলে আসছি, করছিও। সড়ক সংস্কার ও নতুন পাকা সড়ক তৈরিতে জোর দিচ্ছি। রাস্তা ভালো হলে সবার ফুর্তি লাগবে। 

সমকাল: কাজের ক্ষেত্রে ইউপি সদস্যদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: আগে যারা এখানে চেয়ারম্যান মেম্বার ছিল তারা কাজ করেননি। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে কিনা আমি জানি না। তবে আমি এখন প্রচুর কাজ পাচ্ছি। ঈদ উৎসবে মানুষ চায় আমি যেন তাদের পাশে থাকি, সেটা থাকতে পারছি। এবারও ১ হাজার ৪৮৫ জনের হাতে চাল তুলে দিতে পেরেছি। চেয়ারম্যান হিসেবে সব জনপ্রতিনিধিদের বলে দিয়েছি, চুরি করলেই শাস্তি পাবে। 

সমকাল: ইউপি সদস্যরা কি চাইলে চুরি করতে পারে? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: আমরা এই এলাকায় কাজ করি। কিন্তু ফেসবুকে, খবরে অনেক সময় দেখি, শুনতে পাই- চেয়ারম্যান-মেম্বাররা চুরি করে ধরা পড়েছে। যে চুরি করবে, তার হাতে হ্যান্ডক্যাপ পরাবে। আমার কথা হলো, আমি চুরিই বা করব কেন, হ্যান্ডক্যাপই পরব কেন? আমার তো প্রয়োজন নেই এগুলো। আমার আগেও কিছু নেই, পরেও নেই। সরকারি কোনো অনুদান মেরে খাব সেসব ভাবিনি। আমি যতদিন এখানে আছি, কেউ চুরি করতে পারবে না। কাউকে ধরতে পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দেওয়া হবে। আমি চুরি করলে আমাকেও বের করে দেবেন। 


সমকাল: আগামী দিনে নির্বাচন নিয়ে ভাবনা কি? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: এই এলাকার জনগণের ভোটে আমি নির্বাচিত হয়েছি। তারা আমাকে গ্রহণ করেছে। প্রথম দিকে কেউ কেউ আমাকে চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তবে পরে ঠিকই তারা বুঝতে পেরেছেন এবং মেনে নিয়েছেন। আমি আমার কাজটা করছি। এভাবেই কাজটা করে যাব। জনগণের জন্য ভালো কাজ করলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাইতে হবে না। তারাই আমাকে চাইবে। তারা এখনও আমাকে চায়, অনেকে আমাকে থাকতে বলে। 

সমকাল: আপনি সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন কিনা? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: না। আমি কোনো দলের সঙ্গে নেই। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। সরকার আছে, বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। আমি এলাকার মানুষের সঙ্গে আছি। তাদের সঙ্গে থাকতে চাই। 

সমকাল: আপনি বলছেন, জনগণ আপনাকে চায়। আপনি পরবর্তীতে কি উপজেলা নির্বাচন কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনও করবেন? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: না, আমার এমন কোনো পরিকল্পনা নেই। আমি মনে করি, সামনের দিনেও এমন কোনো ভাবনা আসবে না। আমি কোনো রাজনৈতিক দলে নেই, দলীয় কোনো চাপও অনুভব করি না। আমি এই এলাকার চেয়ারম্যান, এখানে আবার হতে পারি কিংবা না পারি এখানকার মানুষের পাশে চেয়ারম্যান হয়ে থাকতে চাই। 

সমকাল: আপনার এই পথচলায় অনুপ্রেরণা কি? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: আমি আগে বলতাম, আমার সংসারধর্ম কিছু নেই। কিন্তু এখন মনে করি, আমার সংসার ধর্ম সবই আছে। এই এলাকার জনগণই আমার সংসার। এটাই আমার ধর্ম। যেহেতু তাদের সঙ্গেই কাজ করি এটাই পরিবার। এখন যত কাজ করছি তত অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। জণগণের সঙ্গে কাজ করে, তাদের সঙ্গেই থাকতে চাই। 

সমকাল: তৃতীয় লিঙ্গের একজন চেয়ারম্যান, জনগণ কি পুরোপুরি গ্রহণ করতে পেরেছে আপনাকে? 

নজরুল ইসলাম ঋতু: অনেকে আগে আমাকে বলতো, ও তো হিজড়া চেয়ারম্যান। কিন্তু আমি এসব কিছু মনে করি না। কারণ একদিন, দুইদিন এবং তিনদিন বলার পর আর বলবে না। কারণ আমি এসব কানে নিই না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মানুষ সালাম দেয়, খোঁজখবর নেয়। চেয়ারম্যান সাহেব বলে ডাকে। আমার অনেক ভালো লাগে। চেয়ারম্যান হয়ে থাকতে চাই। আজীবন এখানেই থাকব। 

আরও পড়ুন

×