ঢাকায় গুলিস্তানের সংঘর্ষে পথচারী নিহত
রেজাউলের বাবার প্রশ্ন– আমার বাপের কী দোষ ছিল

ছেলে হারিয়ে নির্বাক বাবা। শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণখোলা এলাকার বাড়িতে - সমকাল
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ও শেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
বোনকে বলেছিলেন রেজাউল, ছুটি নিয়ে আসব শুক্রবার। কিন্তু আর আসা হয়নি রেজাউলের। শান্তি সমাবেশে দু’পক্ষের সংঘাতে পড়ে নিহত হন তিনি। ডেঙ্গু রোগী রেজাউল করিমকে (২০) চিকিৎসক বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। তাই মাদ্রাসা থেকে ছুটি নিয়ে খিলগাঁওয়ে আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলেন। কিন্তু স্বজনরা তাঁকে খুঁজে পান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশঘরে। প্রথমে অজ্ঞাতনামা থাকলেও পকেটে থাকা মোবাইল ফোনের সিম ধরে জানা যায় তাঁর পরিচয়। রেজাউল ছিলেন যাত্রাবাড়ীর একটি কওমি মাদ্রাসার দাওরা শ্রেণির ছাত্র। তিনি ছিলেন একজন হাফেজ।
রেজাউলের বড় বোন ফারহানা আফরিন সুমি জানান, ভাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বোনের দেবরের বাসায় সেবা নিচ্ছিল। কিছুটা সুস্থ হলে নিষেধ সত্ত্বেও মাদ্রাসায় চলে যায় এবং ছুটি নিয়ে শুক্রবার আসবে বলে জানায়। শুক্রবার বোনের দেবরের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে গুলিস্তানে বাস থেকে নামে। দুপুরে জুমার নামাজ পড়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদে। দক্ষিণ ফটকে তখন চলছিল আওয়ামী লীগের তিন সংগঠনের শান্তি সমাবেশ। সমাবেশফেরত দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে সন্ধ্যায়। সুমি বলেন, ‘মারামারি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় আমার ভাইয়ের বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপরে-পেছনে কেটে গুরুতর জখম হয় এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এরপর ঢামেকে নিয়ে এলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’ আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারীদের ওই সংঘাতে ছুরিকাঘাতে আহত হন পাঁচজন। এদের মধ্যে মৃত্যু ঘটে রেজাউলের।
রেজাউলের বোনজামাই জুয়েল মিয়া সমকালকে বলেন, রেজাউল কখনোই রাজনীতি করেনি। বাড়িতে হেফজ শেষ করে যাত্রাবাড়ীর এক কওমি মাদ্রাসায় দুই বছর ধরে দাওরা শ্রেণিতে পড়ত। তিনি বলেন, ‘নামাজ পড়ে ওই এলাকায় ছিল সে। টুপি-পাঞ্জাবি দেখে হয়তো মনে করছে, জামায়াতের লোক। তাই তার ওপর হয়তো এ হামলা করেছে।’
রেজাউলের বাড়ি শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণখোলা পশ্চিমপাড়া গ্রামে। বাবা আবদুস সাত্তার কৃষক ও মা রেনুজা বেগম গৃহিণী। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে রেজাউল চতুর্থ। বোনেরা সবাই তাঁর বড়। ছোট ভাই নুর মোহাম্মদ এলাকায় মাদ্রাসায় পড়ে। রেজাউল ময়মনসিংহ জামিয়া ফয়জুর রহমান মাদ্রাসা থেকে পড়া শেষ করে ঢাকায় দাওরা হাদিস বিভাগে ভর্তি হন।
গতকাল রোববার রেজাউলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাবা আবদুস সাত্তার বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। মাথায় পানি ঢেলে তাঁকে সুস্থ করার চেষ্টা চলছে। মা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে আহাজারি করছেন, ‘ও আল্লাহ গো, আমার কইলজার টুকরারে তুমি কই নিয়া গেলা? তুমি আমারেও নেওগা গো। স্বর্ণের চাক্কা বাবারে ছাড়া আমি কেমনে থাকমু!’ কিছুটা সুস্থ হলে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, ‘কীসে কী হইল, কিছুই বুঝবার পারতাছি না। কত কষ্ট কইরা লেহাপড়া (লেখাপড়া) করাইতাছি। গতকাইল (গতকাল শনিবার) মোবাইলে কথা হইল। আইজ সকালে শুনি, বাপ আমার নাই। তিনি বলেন, আমার বাপের কী দোষ, ও তো কোনো দল করত না। তাইলে কেন অরে মারল? আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করি, আমার পুলারে যারা মারছে, আপনে তাদের ন্যায্য বিচার করবেন।’ কাঁদতে কাঁদতে রেজাউলের বাবাও বলছিলেন, আমার বাপের কী দোষ ছিল? আমি এর বিচার চাই।
রেজাউলের গ্রামের প্রতিবেশী ও আত্মীয় রাজন মিয়া বলেন, সব সময় হাসিখুশি রেজাউল কোনো সাতে-পাঁচে ছিলেন না। রাজনীতি করতেন না। রোজার মাসে স্থানীয় মসজিদে খতম তারাবি পড়াতেন। বড় ঈদে বাড়ি আসেন। কয়েক দিন পর ঢাকায় চলে যান। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করতেন তিনি।
চরঅষ্টাধর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার সোহেল রানার ভাষ্য, রেজাউল একদম সহজ-সরল, বাচ্চা মানুষের মতো ছিল। বোকা বোকা কথা বলত। সবাই তাকে খুব ভালোবাসত। কোনো দিন কোনো দলের সঙ্গে জড়িত ছিল না। তিনি বলেন, ছেলেটি মারা যাওয়ায় অসহায় মা-বাবার সব শেষ হয়ে গেল।
গত শনিবার সকালে নকলা থানা পুলিশ রেজাউলের মা-বাবাকে তাঁর মৃত্যুর খবর দেয় এবং ঢাকায় গিয়ে লাশ গ্রহণ করে নিজ বাড়িতে আনার অনুরোধ করে। গতকাল রোববার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রেজাউলের লাশ নিতে আসেন স্বজনরা।
এ ঘটনায় শনিবার রেজাউলের বড় বোন ফারহানা আফরিন সুমি বাদী হয়ে পল্টন থানায় মামলা করেন। রোববার রাতে জানাজা শেষে রেজাউলকে গ্রামের সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
পল্টন থানার ওসি সালাহউদ্দীন মিয়া সমকালকে বলেন, গুলিস্তানে দু’পক্ষের সংঘর্ষে মাদ্রাসাছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় শনিবার একটি মামলা হয়েছে। নিহতের বোন ফারহানা আফরিন সুমি বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন। হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে তারা কাজ করছেন।
- বিষয় :
- পথচারী নিহত