দোররা মারার প্রতিবাদ করায় এক যুগ ধরে একঘরে ৪ পরিবার

মানিকগঞ্জের নওগাঁও গ্রামের জাফর শিকদারের বাড়ি। ছবি: সমকাল
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪ | ১৯:৩৯ | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৪ | ১৯:৫৯
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার দড়গ্রাম ইউনিয়নের নওগাঁও গ্রামে এক যুগ ধরে চারটি পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বললেই গুনতে হবে ১ হাজার টাকা জরিমানা। একঘরে করে রাখার বিষয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন জাফর শিকদার নামের ভুক্তভোগী এক ব্যক্তি।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠায় ২০১২ সালে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে উপজেলার নওগাঁও গ্রামে ভিন্ন ধর্মের এক ছেলে ও মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রামে দড়গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ১ নং ওয়ার্ডের তৎকালীন ইউপি সদস্য আবদুর রাজ্জাকসহ গ্রামের মাতুব্বররা তাদের ধরে এনে সালিশ বসায়। সালিশে মেয়েটিকে ১০১ ঘা দোররা মারা হয়। এর প্রতিবাদ করায় নওগাঁও গ্রামের জাফর, তাঁর দুই ভাই সাদেক শিকদার ও আলম শিকদার এবং কাকা জিলাল শিকদারের পরিবারকে একঘরে করে রাখার ঘোষণা দেন ইউপি সদস্য রাজ্জাকসহ বৈঠকে উপস্থিত মাতব্বররা।
গ্রামের অন্যদের সঙ্গে ওই পরিবারের কথাবার্তা বলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় সালিশ থেকে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হলে এক হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এছাড়া পরিবার চারটির বাড়িতে কেউ কাজে যেতে পারবে না, তারাও অন্যদের বাড়িতে কাজে যেতে পারবে না। গ্রামের মসজিদ, মাদ্রাসা ও ঈদগাহে কোনো অনুদান দিতে পারবেন না বলেও নিষেধাজ্ঞায় জারি করা হয়। প্রায় এক যুগ ধরে ওই চারটি পরিবার নিষেধাজ্ঞার আওতায় একঘরে জীবন যাপন করছে।
এ বিষয়ে জাফর শিকদার বলেন, ‘গ্রামের সালিসবিচারে মেয়েটিকে দোররা মারার ঘটনায় আমি প্রতিবাদ করি। তাই আমাদেরকে একঘরে করেন মাতুব্বররা। গ্রামের কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমরা যেতে পারি না। মসজিদ, মাদ্রাসায় আমরা কিছু (অনুদান) দিতে পারি না। এটা আমাদের জন্য শুধু কষ্টের না, লজ্জারও।’
তিনি বলেন, ‘গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়ি না। ঈদের নামাজ অন্য গ্রামে গিয়ে পড়তে হয়। যাকে দোররা মারা হয়েছে সেই মেয়ের পরিবারকে কিন্তু একঘরে করা হয়নি। আমি প্রতিবাদ করায় আমাদের চারটি পরিবারেক একঘরে করে রাখা হয়েছে।’
জাফরের কাকা জিলাল শিকদার বলেন, ‘মাতুব্বররা একঘরে করে রাখায় তিন বছর আগে আমার মেয়ে সালমাকে বাড়িতে বিয়ে না দিয়ে মানিকগঞ্জে আত্মীয় বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান করেছি। আমাদের বাড়িতে অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলে ভয়ে মানুষজন আসে না। মসজিদ, মাদ্রাসায় দান করলে ফিরিয়ে দেয়।’
জাফরের স্ত্রী লিপি বেগম বলেন, ‘কোরবানির ঈদে মাংস আনতে মাঠে গেলে আমাদের পরিবারের জন্য কোনো মাংস দেয় না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রতিবেশী বলেন, ‘জাফর ও তার ভাইয়েরা খেটেখাওয়া মানুষ। গ্রামের কেউ তাঁদের বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে বলে মাতুব্বরেরা হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। এরপর থেকে গ্রামের মানুষ তাদের বাড়িতে যায় না।’
বর্তমান ইউপি সদস্য আবদুর হান্নান হানিফ বলেন, ‘বিষয়টি অনেক দিন আগের ঘটনা। বেশ কয়েকবার মীমাংসা করে দেওয়া চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। কারণ, ওই পরিবারের লোকজনকে মাতুব্বরদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা কেউ যাননি। তাই বিষয়টি মীমাংসা করা যায়নি।’
এ ব্যাপারে সাবেক ইউপি সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ওই পরিবারগুলোকে একঘরে করে রাখার হয়নি। সমাজের লোকজনের সঙ্গে ওই পরিবারের সদস্যদের মেলামেশায় কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে একটি ঘটনা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। গ্রামবাসীদের নিয়ে সবাই মিলে বিষয়টি মীমাংসা করা হবে।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শান্তা রহমান জানান, একঘরে করার বিষয়ে তিনি লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। উপজেলার প্রশাসনের গণশুনানিতে সংশ্লিষ্টদের ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে। এরপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
- বিষয় :
- মানিকগঞ্জ
- সালিশ
- নারী নির্যাতন
- প্রেম