ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ববিতার জীবন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়

ববিতার জীবন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়

স্বামীকে কিডনি দিয়ে বাঁচাতে পারলেও নিজের জীবন রক্ষা করতে পারেননি আশুলিয়ার ববিতা। তাঁর এই ছবি পরিবারের কাছে স্মৃতি হয়ে গেল - সমকাল

 গোবিন্দ আচার্য্য, সাভার

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৪ | ০০:৫০ | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৪ | ০৭:০৩

‘সুখের সংসার’ যাকে বলে, ঠিক সেটাই ছিল নাদিম মণ্ডল ও ববিতা আক্তার দম্পতির। কোনো অভাব-অভিযোগ নেই। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ কাটছিল দিন। এর মধ্যে হঠাৎ নেমে আসে অন্ধকার; অসুখ ধরা পড়ে নাদিমের। চিকিৎসকরা জানান, তাঁর দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। বাঁচাতে হলে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। এ কথা শুনেই ববিতা নিজের একটি কিডনি স্বামীকে দিতে চান। চিকিৎসকরা তাঁকে আশঙ্কার কথা জানালেও তিনি সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। স্বামী বোঝানোর চেষ্টা করলে ববিতা বলেন, ‘বাঁচলে দুজনেই বাঁচব, মরলেও দুজনেই মরব।’ পরে তাঁর একটি কিডনি নাদিমের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। দু’জনেই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন।

এতদূর পর্যন্ত নাদিম-ববিতার জীবনের গল্প একটি মিলনাত্মক বা মধুর পরিসমাপ্তির সিনেমা মনে হতে পারে। কিন্তু নিয়তি বড়ই আজব, নির্মম। কিডনি প্রতিস্থাপনের মাত্র এক বছর পর গত ১৫ এপ্রিল ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন ববিতা। ছিনতাইকারীদের হামলায় আহত হয়ে এক সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তিনি হার মানেন।

সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইলের বগাবাড়ী এলাকায় স্বামী, দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে ছিল ববিতার সংসার। তাঁর ছেলে সাজু মণ্ডল একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। মেয়ে নুসরাতের বয়স চার বছর। সে ঘুমের মধ্যে ‘আম্মু আম্মু’ বলে কেঁদে উঠছে। ছোট্ট নুসরাতকে বুঝিয়ে রাখা হয়েছে, তার মা হাসপাতালে রয়েছেন, কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িতে ফিরবেন।

গতকাল রোববার দুপুরে ব্যবসায়ী নাদিম মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দাদির কোলে বসে আছে নুসরাত। একটু পরপর কেঁদে উঠে সে মায়ের কাছে যেতে চাচ্ছে। পাশেই বসা বাবার কাছে সে জানতে চাচ্ছে, ‘হাসপাতাল থেকে আম্মু কখন আসবে?’ স্ত্রীকে হারিয়ে নিজেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন নাদিম। এই পরিস্থিতিতে মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা যেন তাঁর জানা নেই।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাদিম বলেন, ‘আমি মেয়েটাকে কী করে বোঝাব, ওর মা আর কখনোই ফিরবে না। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ওকে বুঝ দিয়েছিলাম, তোমার আম্মুকে ডাক্তাররা ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছেন। ঘুম ভাঙলে বাসায় নিয়ে যাব। এ কারণে সে বারবার মাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসতে বলছে।’

একটু পর এ প্রতিবেদককে একটি কক্ষে নিয়ে যান নাদিম। সেখানে থাকা ফ্রিজ খুলে কিছু খাবার দেখিয়ে তিনি জানান, ঘটনার দিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে নাদিমের বিকেলের নাশতার জন্য সেমাই রান্না করে রেখে যান ববিতা। দুপুরে ছেলের জন্য মুরগির রোস্ট ও বিরিয়ানি রান্না করেছিলেন। মেয়ের জন্য রান্না করেছিলেন পোলাও। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে নাদিম বলেন, ‘এসব খাবার এখন কে খাবে? বাসার যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শুধু ববিতার স্মৃতি।’

নাদিম মণ্ডল জানান, ২০০২ সালে পারিবারিকভাবে নারায়ণগঞ্জের মেয়ে ববিতার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ২০০৪ সালে তাদের কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান সাজু। এর পর ২০১৯ সালে মেয়ে নুসরাতের জন্ম হয়। ২০১৭ সালে হঠাৎ নাদিমের রক্তচাপ বাড়তে থাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানান, তাঁর দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকটা জোর করে ২০২৩ সালের প্রথম দিকে নাদিমকে ভারতের চেন্নাইয়ে নিয়ে যান ববিতা। সেখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরেন। এর পর ওই বছরের এপ্রিলে হঠাৎ নাদিমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তাঁকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার এক চিকিৎসক দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা বলেন। তখন ববিতা নিজের কিডনি দিতে চান। 

নাদিম বলেন, ‘কিডনি দেওয়ার কথা শুনে আমি ববিতাকে বলি, আমি তো অসুস্থ হয়েই গেছি, কিন্তু তুমি আমাকে কিডনি দিলে দুজনকেই অসুস্থ জীবনযাপন করতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়ের কী অবস্থা হবে? তখন সে বলে, বাঁচলে দুজনেই বাঁচব, মরলেও দুজনেই মরব। এর পর কয়েকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সে আমাকে কিডনি দেয়। আট বছর ধরে ওষুধ খাওয়া থেকে শুরু করে আমার সব দেখভাল করত। মাঝেমধ্যে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লেও আমাকে বুঝতে দিত না। আমি ববিতাকে পেয়ে সত্যিই সুখী হয়েছিলাম। কিন্তু এক ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেল।’

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাদিম-ববিতার ছেলে সাজু জানান, ১৫ এপ্রিল বিকেলে মা, ছোট বোন ও তিন চাচিকে নিয়ে পল্লী বিদ্যুৎ ফুড প্যালেসে ফুচকা খেতে যান তিনি। খাওয়া শেষে সাজু তাঁর মা ও বোনকে নিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার সোহেল স্কয়ার হাসপাতালের বিপরীত পাশে পৌঁছালে একটি মোটরসাইকেলে দুই ছিনতাইকারী ববিতার গলায় ঝুলানো ভ্যানিটি ব্যাগ টান দেয়। এতে রিকশাটি উল্টে সবাই সড়কে পড়ে যান। এ সময় ছিনতাইকারীরা ববিতার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ববিতা মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। তাঁকে দ্রুত পার্শ্ববর্তী একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থা খারাপ হওয়ায় সাভারের বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন স্বজনরা। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।

সাজু মণ্ডল জানান, ছিনতাইয়ের ঘটনার পর তাঁর ছোট চাচা হৃদয় মণ্ডল আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। পরে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু তাদের কাছে সাজুদের ছিনতাই হওয়া আইফোন পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রকৃত দোষীরা এখনও গ্রেপ্তার হয়নি বলে মনে করছেন তারা।

আশুলিয়া থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ জানান, জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে।

আরও পড়ুন

×