ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

থামছে না পাহাড় কাটা অভিযানেও হামলা

থামছে না পাহাড় কাটা অভিযানেও হামলা

কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল এলাকায় পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে স্থাপনা। শুক্রবারের ছবি সমকাল

 ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪ | ২৩:৫৮

আইন, আদালতের নির্দেশ, বন বিভাগের অভিযান কোনো কিছুতেই থামছে না কক্সবাজারে পাহাড় কাটা। জেলার শতাধিক স্থানে দিনদুপুরে কেটে সাবাড় করা হচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড়। বন বিভাগ অভিযান চালালে কিছুদিন বন্ধ রাখার পর ফের শুরু হয় পাহাড়ের মাটি কাটা। পাহাড়খেকোরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, অভিযান চালানোর সময় বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলাও হচ্ছে। সম্প্রতি অভিযানে যাওয়া এক বন কর্মকর্তাকে ডাম্প ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করাও হয়েছে।

জেলাজুড়ে নির্বিচারে পাহাড় কাটায় জড়িত সবাই প্রভাবশালী। নানা অছিলায় ও অভিনব পন্থায় তারা পাহাড় কাটছে। পিছিয়ে নেই সরকারি প্রতিষ্ঠানও। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমি ও গৃহহীনদের ঘর নির্মাণের জন্য কক্সবাজার সদর উপজেলার কদমতলী এলাকায় পাহাড় কেটেছে উপজেলা প্রশাসনই। বন বিভাগ এ নিয়ে আপত্তি জানালেও কানে তোলেননি কেউ।
কদমতলীতে নির্মাণ করা হচ্ছে ১২৫টি ঘর। সরেজমিন দেখা যায়, কক্সবাজার শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ওই এলাকায় অধিকাংশ ঘরই নির্মাণ করা হয়ে গেছে। কিছু ঘরের নির্মাণকাজ চলছে। এ জন্য কাটা হচ্ছে ২০০ ফুট উঁচু তিনটি পাহাড়।

তবে স্থাপনা নির্মাণের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ জাকারিয়ার দাবি, ঘর নির্মাণের জন্য পাহাড় কাটা হচ্ছে না। সড়কের ঝুঁকি কমাতে পাহাড়ের কিছু অংশ কাটা হচ্ছে।
আর চেষ্টা করেও এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। 
পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম কক্সবাজারের তথ্যমতে, জেলা শহরের পাহাড়তলী, বাঁচা মিয়ার ঘোনা, বৈদ্যঘোনা, খাজা মঞ্জিল এলাকা, বাদশাঘোনা, ঘোনারপাড়া, লাইট হাউসপাড়া, কলাতলী, বাইপাস সড়কের দুই পাশ, নতুন জেলা কারাগারসংলগ্ন এলাকা, লারপাড়া, সদর উপজেলার পেছনে, সাহিত্যিকা পল্লী, বিজিবি ক্যাম্পের পেছনে, দক্ষিণ রুমালিয়ার ছড়াসহ শহরজুড়েই চলছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা। এ ছাড়া উখিয়া, রামু, চকরিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। 
ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক ইরফান উল হাসান বলেন, পাহাড় কাটার এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখলে মনে হয়, এসব বন্ধে কেউ নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পেকুয়া উপজেলার টৈটং ইউনিয়নের ডেনারছড়া, রমিজপাড়া ও দক্ষিণজুম এলাকায় গত এক মাসে চারটি পাহাড় কেটে সাবাড় করা হয়েছে। পাশাপাশি শিলখালীর, জারুলবনিয়া, নাপিতেরচিতা, সবুজপাড়া, সাপেরঘারা, মাঝেরঘোনা, বারবাকিয়ার লম্বামোড়া, ভারুয়াখালী, পাহাড়িয়াখালী ও চাকমার ঢুরি এলাকার পাহাড় কাটা চলছে। একইভাবে চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী, রামুর জোয়ারিয়ানালায় মাটি নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়খেকোরা।
এ বিষয়ে পেকুয়া উপজেলার ইউএনও সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আমি যোগদান করেছি মাত্র কয়েক মাস। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়ে চারটি ট্রাক জব্দ করেছি। পাশাপাশি পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলা হয়েছে।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন সরকার সমকালকে বলেন, কক্সবাজারে পাহাড় কাটা হচ্ছে না– এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। বন বিভাগ স্বল্প 
জনবল নিয়েই পাহাড় কাটা বন্ধে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। গত ৩১ মার্চ উখিয়ার হরিণমারা এলাকায় মো. সাজ্জাদুজ্জামান (৩০) নামে এক বিট কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যাও করেছে পাহাড়খেকোরা। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযানে আহত হয়েছেন অন্তত ৮৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তার পরও বন বিভাগ চেষ্টা করছে।
কক্সবাজারের পাহাড় সংরক্ষণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। সংস্থার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সমকালকে বলেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত সব পাহাড় কাটা বন্ধে ২০১১ সালে বেলা একটি জনস্বার্থমূলক মামলা করেছিল। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১২ সালের ১৯ মার্চ আদালত জেলাগুলোয় পাহাড় কাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে পাহাড় কেটে নির্মাণ করা স্থাপনা ভেঙে ফেলার নির্দেশও দেন। উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনার পরও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে না পারা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আমরা পাহাড়ের মালিক নই। শুধু দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করি। নিয়মিত মামলা করছি, জরিমানাও করছি। এ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় পাহাড় কাটা নিয়ে তিন শতাধিক মামলা হয়েছে। অভিযান চালানো হয়েছে হাজারের ওপরে।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে, অভিযান চালায়; কিন্তু পাহাড় কাটা বন্ধ হয় না। অভিযানের সময় জরিমানা করা হয়। জরিমানা দিয়ে অনেকে মনে করেন, তারা বৈধতা পেয়ে গেছেন। কিছুদিন পর আবার পাহাড় কাটা শুরু করেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের নীতি ‘জিরো টলারেন্স’। যখনই তথ্য আসে, জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় এনে থাকে।
 

আরও পড়ুন

×