ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

চট্টগ্রাম কাস্টমসে ‘ঘুষের হাট’, ক্ষতিগ্রস্ত পোশাক খাত

চট্টগ্রাম কাস্টমসে ‘ঘুষের হাট’, ক্ষতিগ্রস্ত  পোশাক খাত

.

 সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪ | ০১:০৬ | আপডেট: ২৫ মে ২০২৪ | ০৭:০৪

চট্টগ্রামের পিওর কেয়ার লিমিটেড শ্রীলঙ্কা থেকে আমদানি করে ২ হাজার ৪০০ লিটার এক্সট্রা ভার্জিন কোকোনাট অয়েল। নন-রিফাইন্ড ক্যাটেগরির চালানটি খালাসে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে আমদানিকারকের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। তবে কাস্টমসের এক রাজস্ব কর্মকর্তা চালানটির এইচএস কোড বদলে এটিকে রিফাইন্ড ক্যাটেগরিতে শুল্কায়নের চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে এক লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। তা না পেয়ে চালান খালাসে একের পর এক খুঁত ধরেন। চাইতে থাকেন নানা রকমের নথি। সব নথি সরবরাহের দুই সপ্তাহ পর চালানটি শুল্কায়ন করা হয়। তবে কাস্টমসের সফটওয়্যারে চালানটি লক করে রাখা হয়। ফলে শুল্কায়ন শেষেও চালানটি যথাসময়ে খালাস করে নিতে পারেননি আমদানিকারক। 

শুধু পিওর কেয়ার লিমিটেড নয়; চাহিদামতো ঘুষ না পাওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিনিয়ত এমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন পোশাক কারখানার মালিকরা। তারা বলছেন, ঘুষ না পেলে কাস্টমস কর্মকর্তারা এইচএস কোড বদলে দেন, ওজন নিয়েও হয়রানি করেন। কায়িক পরীক্ষার নামেও করেন সময়ক্ষেপণ। পণ্য খালাসে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, পণ্য আমদানির পর খালাসের জন্য নানা খাতে ঘুষ দিতে হয়। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে কাস্টমস বলছে, ব্যবসায়ীদের অনেকে রপ্তানির নামে টাকা পাচার করছেন। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আনছেন। এ কাজে কড়াকড়ি আরোপ করায় এখন ঘুষ ও হয়রানির অভিযোগ তুলছেন তারা।

ব্যবসায়ী ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পাল্টাপাল্টি অবস্থানে থাকলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিজিএমইএ নেতারা গত ১৫ মে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখাও করেছেন। এ বৈঠকে অবাধ ঘুষ লেনদেন ও হয়রানির অভিযোগ আনে বিজিএমইএ। বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান কচি ওই বৈঠকে বলেন, ওজনে সামান্য গরমিল, টাইপিংয়ে ভুল ও এইচএস কোড জটিলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৈরি পোশাক রপ্তানি। তৈরি পোশাক পিস হিসেবে রপ্তানির কথা থাকলেও গত দুই বছর আইসিডিতে কার্টন খুলে পোশাকের ওজন পরিমাপ করছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। চাহিদামতো ঘুষ না দিলে এইচএস কোড পাল্টে দিচ্ছেন কর্মকর্তারা। কায়িক পরীক্ষার নামে ১৫ থেকে ২০ দিন অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এসব থেকে আমরা মুক্তি চাই। 

জবাবে কাস্টমস কমিশনার ফাইজুর রহমান বলেন, ‘কাস্টমসে প্রতিবছর ৬০ হাজার কোটি টাকার যে রাজস্ব আসে তা দেন ব্যবসায়ীরাই। তাদের যাতে হয়রানি না হয়, সেজন্য সচেষ্ট আছে কাস্টমস ও এনবিআর। তার পরও যদি কোথাও হয়রানি হচ্ছে বলে মনে করেন, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমি ব্যবস্থা নেব। তবে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় তদারকি বাড়ার কারণে কেউ কেউ হয়তো ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তারা হয়রানির মিথ্যা অভিযোগ আনতে পারেন। এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে বিজিএমইএকেও।’

তবে পিওর কেয়ার লিমিটেডের মালিক শোয়েব কবির সমকালকে সম্প্রতি বলেন, ‘চাহিদামতো ঘুষ না দেওয়ায় দুই সপ্তাহ নারকেল তেলের চালানটি অকারণে আটকে রাখা হয়েছিল। এক পর্যায়ে চালানটি সফটওয়্যারে লক করে দেওয়া হয়। সময়মতো সরবরাহ করতে না পারায় পণ্যটির অর্ডার বাতিল করা হয়েছে। কাস্টমস এভাবে হয়রানি করলে আমরা ব্যবসা করব কীভাবে?’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এ মুহূর্তের বড় বাধা এইচএস কোড-সংক্রান্ত জটিলতা। এ জটিলতা তৈরি করে ঘুষের রেট বাড়ান কাস্টমসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। ব্যবসায়ীরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পকেট ভারী হচ্ছে ঘুষখোর কর্মকর্তাদের। হয়রানির এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে বিজিএমইএ। এতে উল্লেখ করা হয়, আমদানি করা পণ্য চালানের সংশ্লিষ্ট এইচএস কোড বন্ড লাইসেন্সে উল্লেখ না থাকলে অঙ্গীকার নিয়ে দ্রুত শুল্কায়ন করা হতো। এখন তাতে হয়রানি করা হচ্ছে। আগে এইচএস কোড বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত না থাকলে পরবর্তী সময়ে বন্ডার থেকে বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত করে শুল্কায়নের জন্য উপস্থাপন করা হতো। এখন জরিমানা আরোপ করা হচ্ছে। আবার এ জরিমানার হার নির্ধারণ নিয়ে বসে ‘ঘুষের হাট’। চাহিদামতো ঘুষ না পেলে জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে বন্ডের আওতায় আমদানি কাঁচামাল ছাড় করতেও জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। রপ্তানিকারকের পক্ষে লিড টাইমের মধ্যে পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেক রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

ঘুষের ৩০ খাত
পণ্য খালাসে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন। তাদের দাবি, পণ্য আমদানির পর খালাসের জন্য ৩০ খাতে, বন্দর থেকে রিলিজ নিতে ১৮ খাতে এবং বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ১১ খাতে ঘুষ দিতে হয়। শিপিং কোম্পানিগুলো জাহাজে কী পণ্য নিয়ে এসেছে, তার বর্ণনা কাস্টমসে জমা দিতে হয়। এগুলোকে বলা হয়, ইমপোর্ট জেনারেল মেনিফেস্ট (আইজিএম)। নিয়ম অনুযায়ী, জাহাজ বন্দরে আসার ২৪ ঘণ্টা আগে কাস্টমসে আইজিএম জমা দিতে হবে। কাস্টমসের নেটিং সেকশনে সেই আইজিএম জমার পর থেকেই শুরু হয় ঘুষ বাণিজ্য। আইজিএম যাচাই করতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয় পিয়ন, ক্লার্ক, চেকার, বিল অব এন্ট্রি, কম্পিউটার অপারেটর, জরুরি প্রিন্ট, লজমেন্ট সেকশন বা গ্রুপে প্রেরণ, অ্যাপ্রাইজার, প্রধান অ্যাপ্রাইজার, নোটিশ প্রিন্ট, আন্ডার ইনভয়েস সামলানো, আউটপাস, সিল মারা, ডিউটি প্রদানে, রিলিজ অর্ডার নেওয়া, অনাপত্তি সিল দেওয়া, মালপত্র পরীক্ষার সময় রেপিটর, সাব-ইন্সপেক্টরসহ বিভিন্ন খাতে। এমনকি আমদানি পণ্য ভর্তি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রেও ঘুষ দিতে হয় ইকুইপমেন্ট বুকিং, শেডের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর, ট্রেইলার অপারেটর, টালি ক্লার্ক, ডক শ্রমিক, উইন্সম্যানসহ নানা খাতে। ঘুষ না দিলে বন্দর থেকে পণ্য বের করা কঠিন।

কোথায় কত ঘুষ
ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটি চালান কাস্টমস থেকে রিলিজ করতে ঘুষের পরিমাণ গড়ে ক্ষেত্রবিশেষে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। টেক্সটাইল মেশিনারিজ, কাগজ ও মণ্ড, কসটিক সোডা, প্লাস্টিক মোল্ডিং কম্পাউন্ড, হার্ডবোর্ড বা ডুপ্লেক্স বোর্ড, পার্টস ও মেশিনারি, টিনপ্লেট, কাঠ, গুঁড়া দুধ, এসিড, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ইত্যাদির ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হয় ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় লিফট, বিভিন্ন ফলদদ্রব্য, প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য, বিভিন্ন রকম তেল, গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ, তুলা, সুতা, ফিল্ম সরঞ্জাম কেমিক্যাল, খাদ্যশস্য ইত্যাদি পণ্যের ক্ষেত্রে। জাহাজ এবং কনটেইনার কোম্পানিগুলোকে ঢাকার আইসিডিতে পণ্য নিতে ৩ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। আর বাল্ক কার্গোর ক্ষেত্রে ঘুষ গুনতে হয় প্রতি টনে। 

এইচএস কোড দিয়ে হয়রানি যেভাবে
এইচএস কোড (হারমোনাইজড সিস্টেম) হলো পণ্য শুল্কায়নের একটি বৈশ্বিক মানদণ্ড। এটি বিভিন্ন পণ্যকে প্রায় ৫ হাজার কমোডিটি গ্রুপে শ্রেণিবদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্ক মূল্যায়নের সময় পণ্য শনাক্ত করতে এটি ব্যবহার করে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ হাজার বিল অব এন্ট্রি আমদানি করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্যের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পোশাক শিল্পের কাঁচামাল। এসব পণ্য শুল্কমুক্ত বা বন্ডেড গুদাম সুবিধা নিয়ে আমদানি করা হয়।

ওজন গরমিলে ঘুষ বাড়ে
প্রাইভেট আইসিডিতে রপ্তানিযোগ্য গার্মেন্ট পণ্যের কার্টন খুলে প্রতিটির ওজন করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে বিল অব এন্ট্রি এবং বিল অব এক্সপোর্টের নথির সঙ্গে পণ্যের বিবরণও মিলিয়ে দেখা হয়। এটি করতে গিয়ে ঘুষের একটি চক্র গড়ে উঠেছে। তারা চাহিদামতো ঘুষ না পেলে ওজনে গরমিল দেখায়। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ‘কাস্টমস যেভাবে পোশাকের ওজন পরিমাপ করছে, সেটা ঠিক নয়। বিশেষ করে ওভেন কাপড় মিটারে ওজন করা হয়। ওজনে গরমিলের কারণে চালান আটকে দেওয়ায় জাহাজ মিস হচ্ছে। এর ফলে বাতিল হচ্ছে অর্ডার। ব্যবসা চলে যাচ্ছে ভারত ও নেপালের হাতে।’

অভিযোগের তীর এক ডেপুটি কমিশনারের দিকে
কাস্টমসের এক ডেপুটি কমিশনারের নেতৃত্বে ‘ঘুষের হাট’ বসেছে বলে অভিযোগ করেছে বিজিএমইএ। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনও মনে করছে, চাহিদা মতো ঘুষ না পেলে হয়রানি করছে কাস্টমস। আর এ চক্রে কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তাও জড়িত। তাদেরও অভিযোগের তীর ওই ডেপুটি কমিশনারের দিকে। তাদের অভিযোগ, যে কোনো মালপত্র খালাসের জন্য তাঁর কাছে ফাইল গেলে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মতামতকে প্রাধান্য দেন। দেশের প্রচলিত কাস্টমস বিধি তিনি মানেন না। এতে পোর্ট ডেমারেজসহ অন্যান্য ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে পোশাক মালিকদের। পণ্য চালান খালাসে হয়রানি আরও বেড়ে যাওয়ার ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে স্বনামে বক্তব্য দেননি কেউ। তবে চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, ‘কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা আমদানিকারককে হয়রানি করছেন, যা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশে কাম্য নয়। কেউ সরাসরি ঘুষ নিচ্ছেন। আবার কেউ ঘুষের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ডেপুটি কমিশনার তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘অবৈধভাবে কিংবা মিথ্যা ঘোষণায় যারা পণ্য আনেন, তারাই আমার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। আমি বিধিবদ্ধ নিয়মেই পণ্য শুল্কায়ন করছি।’

আরও পড়ুন

×