মুন্নীর মান রাখলেন দেওয়ানগঞ্জবাসী

বিজয়ের পর এলাকাবাসীর সঙ্গে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান মুন্নী আক্তার সমকাল
রাজ্জাক মিকা, দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর)
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৪ | ২৩:৪১ | আপডেট: ২৮ মে ২০২৪ | ০৯:২৮
হিজড়া হওয়ায় সমাজে পদে পদে তাদের লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। প্রতি মুহূর্তে উড়ে আসে নানা কটূক্তি, কটাক্ষের চাহনি। তাদের একজন মুন্নী আক্তার দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান পদে পেয়েছেন ২৩ হাজার ৭৬৮ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে তাঁর ভোটের ব্যবধান দুই হাজার ৫৮৪।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে মুন্নীর জয়ের পেছনে ভূমিকা রেখেছে জনসাধারণের সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়ার অভ্যাস; বলেছেন স্থানীয় লোকজন। মুন্নী আক্তার জনগণের এ ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চান সেবার মাধ্যমে। এখন সমাজে তাঁর প্রবেশগম্যতা স্বাভাবিক মানুষের মতোই। এই জয়কে তিনি বড় করে দেখছেন।
মুন্নী আক্তার সমকালকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। নিজের অবস্থান গড়তে আমাকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আজ আমি সার্থক। দেওয়ানগঞ্জবাসী আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচনে জয়ী করেছেন। লিঙ্গের ভেদাভেদ ভুলে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। তাদের সেবা দিতে চাই। তাদের ভালোবাসা নিতে চাই।’ পাশাপাশি নিজ সম্প্রদায়ের উন্নয়নও তাঁর লক্ষ্য।
১৯৯৬ সালে জামালপুর সদর উপজেলায় জন্ম মুন্নীর। নুর ইসলাম-রেজিয়া খাতুন দম্পতির এ সন্তান শৈশব থেকেই নানাবাড়ির বাসিন্দা। নানা নিজাম শেখের বাড়ি দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চরআমখাওয়া ইউনিয়নের চরমাদার গ্রামে। বুঝতে শেখার পর থেকেই লৈঙ্গিক ভিন্নতার কারণে মুন্নী আক্তার পরিবারের সদস্যদের আড়ালে বিভিন্ন মানুষের লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। সয়েছেন গঞ্জনা-কটাক্ষ, তবুও দমে থাকেননি। ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। অর্থাভাবে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
কয়েক বছর আগে তিনি দেওয়ানগঞ্জের কালিকাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পেশা হিসেবে বেছে নেন কৃষি ও ব্যবসাকে। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি পুরো সমাজের সেবা নিয়েই ভাবতে থাকেন। সেই থেকে মানুষের সঙ্গে মেশা শুরু করেন। বিপদ-আপদে এগিয়ে যান। এভাবেই তিনি বহু মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে ওঠেন।
সানন্দবাড়ীর বাসিন্দা মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, মুন্নী আক্তার খুব ভালো মানুষ। সবার সঙ্গে মেশেন। সুখ-দুঃখে সাধ্যমতো পাশে দাঁড়ান। ভালো আচরণ করেন। দেখা হলে খোঁজখবর নেন। এমন মানুষকে ভাইস চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসাতে পেরে আনন্দিত।
ডাংধরার মো. জাহাঙ্গীর আলমের ভাষ্য, মুন্নী সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলেন। নির্বাচনে তাঁর এসব গুণ বিবেচনা করেন ভোটাররা। এ কারণেই জয়ী হয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে ভালো কিছু পাবেন– মানুষের মধ্যে এমন আশা জন্মেছে।
মুন্নী আক্তারের কাছে প্রথমে অগ্রাধিকার পাবে উপজেলায় বসবাসরত ৭০ জন হিজড়া। তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের কর্মসংস্থানকে লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন। তাঁর চাওয়া, জীবিকার জন্য যেন মানুষের দ্বারে দ্বারে আর যেতে না হয় তাদের। সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে এবং বঞ্চিত, নিপীড়িত ও হতদরিদ্র মানুষের সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিতে চান তিনি।
লিঙ্গগত বৈষম্যের শিকার হয়েও মানুষের প্রতিই আস্থা রাখেন মুন্নী। তিনি বলেন, মানুষ তো মানুষই। লিঙ্গগত বৈষম্য আপেক্ষিক ব্যাপার। এটি সাম্প্রদায়িক হীনচেতনার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে এলাকার সর্বস্তরের মানুষ এখন তাঁকে ভালোবাসেন। তাই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। এখন সমাজে তাঁর প্রবেশগম্যতা স্বাভাবিক মানুষের মতোই। এই জয়কেই বড় করে দেখছেন মুন্নী।
নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের চোখে মুন্নী আক্তার একজন মানুষ। এটিই তাঁর বড় পরিচয়। তিনি বলেন, জনগণ তাদের সেবার জন্য, উন্নয়নের জন্য মুন্নীকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছেন। চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করবেন না। দায়িত্ব পালনে সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি।
- বিষয় :
- হিজড়া