আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণে অনিয়ম

নান্দাইলের মহেষকুড়া আশ্রয়ণের ঘরের খাপ ভেঙে পড়ছে সমকাল
মজুমদার প্রবাল, নান্দাইল (ময়মনসিংহ)
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৪ | ০০:১৫
নান্দাইলে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীন জরাজীর্ণ ব্যারাক প্রতিস্থাপনে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কারণে ভিটায় ফাটল ধরেছে, খুলে পড়ছে জানালা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এসব ঘর ভূমি ও গৃহহীন পরিবারে হস্তান্তরের কথা রয়েছে।
নান্দাইল উপজেলার চর মহেষকুড়া, বারোপাড়া, মেরাকোনা ও ভাটি পাঁচানী গ্রামে ২০০১ সালে আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এসব ঘরে বসবাস করে আসছেন গৃহহীনরা। কিন্তু সংস্কার না হওয়ায় ঘরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় জরাজীর্ণ ঘর অপসারণ করে আধাপাকা বাড়ি নির্মাণের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। সে অনুযায়ী চর মহেষকুড়া আবাসন প্রকল্পে ১০৯টি, মেরাকোনায় ৫৪টি, বারোপাড়ায় ১৯টি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি ঘরের জন্য ৩ লাখ ৪ হাজার ৫০০ টাকা হিসাবে মোট ৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। নির্মাণসামগ্রী পরিবহন খাতে রয়েছে আরও ৫ হাজার টাকা করে। কাজ বাস্তবায়নে চার সদস্যের কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সদস্য সচিব প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও), সদস্য উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান। অভিযোগ রয়েছে, ইউএনও কমিটির কারও মতামত না নিয়েই চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঠিকাদার এনে সব কাজ করান। ঘর নির্মাণের সব মালপত্রও তিনি এনেছেন নিজ জেলা নেত্রকোনা থেকে।
গত দুই দিন বিভিন্ন আশ্রয়ণ ঘুরে ঘর নির্মাণে দুর্নীতির চিত্র দেখা গেছে। খারুয়া ইউপির চর মহেশকুড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে দেখা যায়, ঘর নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে অপরিপক্ব ইউক্যালিপটাস কাঠ। চালে ২ ইঞ্চি বাই ২ ইঞ্চি কুড় ব্যবহারের কথা থাকলেও পৌঁনে দুই বাই পৌনে দুই কুড় এবং ২ বাই ১ ইঞ্চি খাপের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে পৌনে ২ বাই পৌনে ২ খাপ। ১৩ ফুট চালে দেওয়া হয়েছে ৬টি কুড় ও ৪টি খাপ। পেছনের বারান্দায় কাঠ বাঁচাতে গিয়ে চালের টিন এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যে, একটু বৃষ্টিতেই ঘরে পানি ঢুকছে। জানালায় দেওয়া হয়নি কোনো সানশেড।
চর মহেশকুড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের সভাপতি আবদুর রহিম জানান, ঘর নির্মাণে ২ ও ৩ নম্বর ইট এবং নিম্নমানের টিন, কাঠ, কম পরিমাণে বালু, সিমেন্ট ব্যবহার করায় কাজের মান খারাপ হয়েছে। তারা এসবের প্রতিবাদ করলেই ইউএনও রেগে ঘর দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিতেন।
আবুল কাশেম নামে একজন বলেন, ‘চালের স্ক্রুগুলো স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে না বসিয়ে হাতুড়ির আঘাতে বসানো হয়েছে। এ কারণে সেখান দিয়ে পানি পড়ে ঘর ভেসে যাচ্ছে।’
পুরোনো প্রতিটি ঘরও ভালো দামে বিক্রি করা হয়েছে। সে টাকা কোথায় এবং কোন খাতে জমা হয়েছে– এমন প্রশ্ন তুলেছেন আশ্রয়ণের বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, নতুন করে আধাপাকা একেকটিক ঘর নির্মাণে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।
মেরাকোনা প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখনও কাজ চললেও কোথাও কোথাও জানালা খুলে পড়েছে। দরজা-জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের প্লেনশিট। এসব শিট জোড়ায় রয়েছে ফাঁকা। সেখান দিয়েও ঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকছে। কয়েকটি নতুন ঘরের ভিটায় ফাটল ধরেছে। নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করায় অনেক ঘরের বারান্দার চালা নিচের দিকে ঝুলে গেছে। ঘরের মেঝে ৩ ইঞ্চি ঢালাই দেওয়ার কথা থাকলেও কাদামাটিতে মাত্র দেড় ইঞ্চি ঢালাই দেওয়া হচ্ছে। পিলারে ১২ এমএম রড দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে ১০ এমএম।
বাসিন্দা লাকি আক্তার ও আব্দুল হেকিম জানান, কাজ নিয়ে কোনো কথা বললেই ধমক দিয়ে ঠিকাদার বলেন, ‘আপনারা কি ইঞ্জিনিয়ার, এত বোঝেন কেন! ৪৫ হাজার টাকায় এর চেয়ে ভালো ঘর কীভাবে পাবেন?’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঠিকাদার কামরুল ইসলাম জানান, সব নির্মাণসামগ্রী এনে দিয়েছেন ইউএনও। শ্রমিক লাগিয়ে শুধু ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন তিনি। প্রতিটি ঘর তৈরিতে শ্রমিক বাবদ নিচ্ছেন ৪৫ হাজার টাকা।
হাতেম আলী নামে এক বাসিন্দার অভিযোগ, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আশপাশের ভূমিহীন পরিবার বাদ দিয়ে দূর-দূরান্তের সচ্ছল ব্যক্তিদের টাকার বিনিময়ে ঘর দেওয়া হচ্ছে। আগের অনেক বাসিন্দাকেও নতুন ঘর দেওয়া হচ্ছে না। একই ]চিত্র দেখা গেছে মুশুলী ইউপির বারোপাড়া প্রকল্পে।
খারুয়া ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল হাসনাত ভূঁইয়ার ভাষ্য, তিনি কমিটিতে আছেন; কিন্তু কাজের বিষয়ে কিছুই জানেন না। ইউএনও কাজ করাচ্ছেন, সবকিছু তিনিই বলতে পারবেন।
কমিটির সদস্য সচিব পিআইও আহসান উল্লাহ জানান, তিনি কমিটির সদস্য সচিব হওয়ায় কাজের সব দায়ভার তাঁর হলেও কাজ করিয়েছেন ইউএনও।
নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অরুণ কৃষ্ণ পাল বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রকৌশলীসহ নান্দাইল উপজেলা প্রকৌশলীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি। এখন পর্যন্ত কাজের মান নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।’
- বিষয় :
- আশ্রয়ণ প্রকল্প