সংরক্ষিত কোটার প্লটও নেন মন্ত্রী-এমপি আওয়ামী লীগ নেতা
কেডিএর ময়ূরী প্রকল্পে অনিয়ম

ফাইল ছবি
হাসান হিমালয়, খুলনা
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৫ | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৪:৩০
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) ময়ূরী আবাসিক প্রকল্পে শতাধিক প্লট বাগিয়েছিলেন সে সময়ের মন্ত্রী-এমপি, সিটি মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা। অভিযোগ উঠেছে, অনিয়ম করে ‘সংরক্ষিত কোটা’য় এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
২০১৮, ২০২০ ও ২০২২ সালে নামমাত্র মূল্যে এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। অনিয়ম নিয়ে সমকালে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে তড়িঘড়ি করে অনেকে প্লট রেজিস্ট্রি করে নেন, অনেকে বিক্রি করেন।
সম্প্রতি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষকে ‘সংরক্ষিত কোটা’য় বরাদ্দ দেওয়া প্লটের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে কেডিএর প্লট বরাদ্দে অনিয়মের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
সংরক্ষিত কোটা কী
গত সরকারের আমলে আবাসন প্রকল্পের ১৫ শতাংশ প্লট পূর্তমন্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতায় বরাদ্দ হয়। একেই বলা হয় ‘সংরক্ষিত কোটা’। মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা এ কোটায় কেডিএর ময়ূরী আবাসিক প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ পান।
কোটায় প্লট নিয়েছেন যারা
ময়ূরী আবাসিক প্রকল্পে প্লট বিক্রির জন্য আবেদন ফরম বিক্রি শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট। নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ জামানত দিয়ে প্লটের জন্য ২ হাজার ৩৬০ জন আবেদন করেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে ৬২৯টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালে প্রথম সংরক্ষিত কোটায় ৭৯টি প্লট বরাদ্দের জন্য কেডিএতে চিঠি দেন তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ।
সংরক্ষিত কোটায় ওই সময় পাঁচ কাঠার প্লট বরাদ্দ পান খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেসিসির অপসারিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, তাঁর ভাই আবদুল জলিল তালুকদার, সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী ও এমপি বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, প্রয়াত এমপি মোস্তফা রশিদী সুজা, কবিরুল হক মুক্তি, চট্টগ্রামের এমপি মাহাবুবুর রহমান, সংরক্ষিত এমপি ফাতেমাতুজ জোহরা, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, খালিশপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম বাশার, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদীন রশিদী সুকর্ন এবং ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেন।
সংরক্ষিত কোটায় তিন কাঠার প্লট পান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শরফুদ্দিন বিশ্বাস বাচ্চু, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও তাঁর ভাই খালেকুজ্জামান, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি শাহজালাল হোসেন সুজন এবং সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম।
প্লট বরাদ্দে বড় অনিয়ম ময়ূরী প্রকল্পে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬২৯টি প্লট। তবে ২০২০ সালে প্রকল্পের অবকাঠামোর কাজ শেষ হলে বেশ কিছু প্লট ফাঁকা পাওয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী, আবেদনকারীদের মধ্যে ওই প্লট বরাদ্দ হওয়ার কথা। কিন্তু এই নিয়ম মানা হয়নি। ওই বছর ৩২টি এবং ২০২২ সালে ১৫টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় অন্যদের।
ওই সময় কোটায় পাঁচ কাঠার প্লট নিয়েছেন খুলনা-৪ আসনের সাবেক এমপি আবদুস সালাম মুর্শেদী, খুলনা-৬ আসনের আকতারুজ্জামান বাবু, সংরক্ষিত আসনের গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার ও রুনু রেজা, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা, কেডিএর সাবেক পরিচালক ড. শাহানুর আলম ও পরিচালক এস্টেট ছাদেকুর রহমান, কেডিএর কয়েকজন বোর্ড সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এবং মন্ত্রীর পিএস। খুলনা জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নামেও প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
ইচ্ছামতো নিয়ম তৈরি
ময়ূরী প্রকল্পের নীতিমালায় বলা রয়েছে, প্লট বরাদ্দের আগে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন চাইতে হবে। ওই আবেদন যাচাই-বাছাই হয়ে কেডিএর প্লট বরাদ্দ কমিটির সভায় উত্থাপন হবে। কমিটির সুপারিশ বোর্ডসভায় উত্থাপন হলে বোর্ড প্লট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এ নিয়ম বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন– শুরুতেই ১৫ শতাংশ প্লট (৯৭টি) সংরক্ষিত কোটায় বরাদ্দের জন্য রাখা হয়। এ ছাড়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছাড়াই বোর্ড অনুমোদন দিলে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম তৈরি করা হয়।
কোটি টাকার বাণিজ্য
কেডিএর একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ নেতা ও কিছু আমলা এই প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন ৯ লাখ ও ১৫ লাখ টাকা কাঠা দরে। ২০১৯ সালের আগে যারা বরাদ্দ নিয়েছেন, তারা পাঁচ কাঠার প্লট সাড়ে ৪৭ লাখ টাকায়, আর যারা পরে প্লট পেয়েছেন তারা ৭৫ লাখ টাকায় প্লট কেনেন। বাস্তবে ময়ূরী আবাসিকে পাঁচ কাঠা প্লটের দাম আড়াই থেকে ৩ কোটি টাকা। ফলে প্লট বরাদ্দ পেয়ে এক বছরের মধ্যে বিক্রি করে অনেকে কোটি টাকার বেশি লাভ করেন। এর মধ্যে রয়েছেন এম ডি এ বাবুল রানা, কেডিএর সাবেক কর্মকর্তা শাহানুর আলম ও ছাদেকুর রহমান।
খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি কুদরত ই খুদা বলেন, ‘সাধারণ মানুষ মোটা অঙ্কের টাকা জমা দিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করে প্লট পাননি। অথচ আবেদন না করে অনেকে প্লট পেয়েছেন।’ প্লট বরাদ্দে এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনিয়ম জায়েজ করতে তারা বারবার নিয়ম পরিবর্তন করেছে। এসবের শাস্তি হওয়া উচিত।’
এ বিষয়ে কেডিএর চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম মিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগে সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ হয়েছে। ওইসব প্লটের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি। এলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’