কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স
নৌকা আদলের মঞ্চ এখন পুলিশের ‘গলার কাঁটা’

পুলিশ লাইন্স মাঠে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি উদ্বোধন করা স্থাপত্যটির নাম দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু মঞ্চ– ‘তরণী’।
কামাল উদ্দিন, কুমিল্লা
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১১:০৯ | আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১২:৩৭
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের নৌকা আদলে মঞ্চ তৈরি করে আলোচনায় এসেছিলেন কুমিল্লার তৎকালীন পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম।
পুলিশ লাইন্স মাঠে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি উদ্বোধন করা স্থাপত্যটির নাম দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু মঞ্চ– ‘তরণী’। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশ লাইন্সে ঢুকে মঞ্চটিতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। ভেঙে ফেলা হয় এর দুই প্রান্তসহ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ও ৭ মার্চ ভাষণের ম্যুরাল। আলোচিত মঞ্চটি এখন পুলিশের ‘গলার কাঁটা’। এটি অপসারণ করা হবে, নাকি সংস্কার করা হবে– তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেয়নি জেলা পুলিশ। তবে এ নিয়ে জেলা পুলিশ একটি তদন্ত কমিটি করেছে বলে সমকালকে জানিয়েছেন বর্তমান পুলিশ সুপার।
এসপি আসফিকুজ্জামান আকতার সমকালকে বলেন, মঞ্চটির বিষয়ে সম্প্রতি একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তারা প্রতিবেদন দিলে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মঞ্চটির ভবিষ্যৎ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখনই এ নিয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে জানা যায়, পুলিশ লাইন্স প্যারেড মাঠে মঞ্চটির নির্মাণকাজ ২০২০ সালের মার্চে শুরু হয়ে শেষ হয় ডিসেম্বরে। ব্যয় হয় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এটি উদ্বোধন করেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কুমিল্লার এসপি সৈয়দ নুরুল ইসলাম ২০২২ সালের অক্টোবরে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে নিয়োগ পান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন পর্যন্ত ওই দায়িত্বে ছিলেন। সম্প্রতি তাঁকে ওএসডি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে নুরুল ইসলামের বক্তব্য জানতে তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। সরেজমিন পুলিশ লাইন্স মাঠে দেখা যায়, নৌকাটির বাঁয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের এবং ডানে দুই মাঝির ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। পেছনের অংশে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ম্যুরালটির কিছুই অবশিষ্ট নেই। নৌকার দু’পাশে সাজঘর দুটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেয়ালগুলোতে পোড়া ক্ষত। নৌকাটির পেছনে উদ্বোধনী স্মৃতিস্তম্ভটি ঢেকে দেওয়া হয়েছে চটের বস্তা দিয়ে। জনতা নতুন করে নাম লিখে দিয়েছে ‘স্বাধীন বাংলা মঞ্চ’।
পুলিশ জানায়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দিন একদল লোক পুলিশ লাইন্সে ঢুকে হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে মঞ্চটিতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তারা পুলিশ লাইন্সের ভেতর ভাঙচুরের পাশাপাশি অস্ত্র ও পুলিশের রেশন লুটপাট করে। আগুন দেয় অনেক যানবাহনে।
এদিকে উদ্বোধনের সময় মঞ্চটির নির্মাণশৈলী দেখে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রশংসা করলেও পুলিশের কেউ কেউ নেতিবাচক মন্তব্যও করেছিলেন। তবে এখন আংশিক ভেঙে ফেলা মঞ্চটির ভবিষ্যৎ নিয়ে পুলিশের দায়িত্বশীল কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, নৌকার আদলে পুলিশ লাইন্সের ভেতরে সোয়া কোটি টাকা ব্যয় করে মঞ্চটি তৈরি করা ঠিক হয়নি। এখন দ্রুত অপসারণ করাই উচিত। একই ধরনের মন্তব্য করেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক এমপি আমিন উর রশিদ ইয়াছিন।
তিনি বলেন, সরকার পতনের কয়েক দিন পর পুলিশ সুপারের আমন্ত্রণে পুলিশ লাইন্সের ভেতর ক্ষয়ক্ষতি দেখতে গিয়ে মঞ্চটি দেখেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়ে একটি দলের প্রতীকের আদলে এমন মঞ্চ তৈরি আমার দৃষ্টিতে ঠিক হয়নি।
মঞ্চটিতে যা ছিল
১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট প্রস্থের নৌকাটির মাঝে ছিল ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৮ ফুট প্রস্থের একটি আধুনিক মঞ্চ। এর দু’পাশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দুটি গ্রিনরুম। ওপরে সুবিন্যস্ত মেটালিক শেড ও ট্রাস। ছিল বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত প্রথম পতাকার আদলে ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থের নৌকার পাল। ১২ ফুট উচ্চতার বঙ্গবন্ধুর এবং দুই মাঝির ভাস্কর্যও তৈরি করা হয়। এ ছাড়া মঞ্চের পেছনে স্থপতি মৃনাল হকের তৈরি ২৩ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট প্রস্থের ম্যুরালে ছিল ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দৃশ্য। নানা রঙের আলোকসজ্জার ব্যবস্থাও ছিল এতে।
- বিষয় :
- কুমিল্লা
- পুলিশ
- পুলিশ বাহিনী