রোগাক্রান্ত পশুর মাংস বিক্রি তদারকি নেই কর্তৃপক্ষের

ফাইল ছবি
শাহজাহান সোহেল, সাদুল্লাপুর (গাইবান্ধা)
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ | ২২:৪৬
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার কাজীবাড়ী সন্তোলা গ্রামের খামারে কয়েকদিন আগে একটি গাভি অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকিৎসার পরও সুস্থ না হওয়ায় পশুটি জবাই করেন খামারি। খবর পেয়ে এক কসাই এসে গাভিটি ১৫ হাজার টাকায় কিনে নেন। বস্তায় ভরে মাংস নিয়ে যান গভীর রাতে। পরদিন সেগুলো বিক্রি করেন বাজারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খামারির ভাষ্য, গাভিটি তিনি কিনেছিলেন ৮৭ হাজার টাকায়। জবাইয়ের পর বিক্রি করে যে টাকা পেয়েছেন, তাতে লোকসান কিছুটা কমেছে।
মানুষই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যায়, সেখানে পশু অসুস্থ হতেই পারে বলে মন্তব্য করেন কসাই গনি মিয়া। তাঁর ভাষ্য, সামান্য অসুস্থ পশু কিনলে দোষের কিছু নেই। মানুষের মতো গরু-ছাগলেরও সর্দি-জ্বর হয়। তাই বলে এসব পশু কি জবাই করা যাবে না? এসব পশু না কিনলে খামারিদের ব্যবসা থাকবে না। তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে কসাইদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই হবে।
সাদুল্লাপুর কলোনি মোড়ের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানের এক প্রতিবেশীর বিদেশি জাতের গাভি বাচ্চা প্রসবের সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে। দু’দিন চিকিৎসা দিয়েও সুস্থ হয়নি। পরে কসাইরা প্রায় ৭ মণ ওজনের গাভিটি ৬০ হাজার টাকায় কিনে নেন জানিয়ে তিনি বলেন, পশুটি গোপনে জবাইয়ের পর মাংস বিক্রি হয়েছে কেজি দরে। এটি দেখে বাজার থেকে মাংস কেনা বাদ দিয়েছেন তিনি। প্রয়োজন হলে কয়েকজন মিলে গরু কিনে ভাগ করে নেন।
এ দুই ঘটনাতেই শেষ নয়, উপজেলায় এভাবে রোগাক্রান্ত পশুর মাংস বিক্রির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। নেপথ্যে রয়েছে কিছু অসাধু কসাই। কয়েক মাস আগে স্থানীয় এক কৃষকের অসুস্থ গরু কেনেন তারা। সেটি জবাই করে মাংস বিক্রি করেন বাজারে। বিষয়টি জানাজানি হলে কসাইরা অসুস্থ গরু জবাইয়ের অভিযোগ অস্বীকার করেন। ক্রেতা হাবিবুল ইসলামের ভাষ্য, তারা সবসময় সুস্থ গরুর মাংস বিক্রির কথা বলে। এতেই বিশ্বাস করতে হয়। বাজারে তো পশু পরীক্ষার কেউ নেই।
রোগে গরু মারা গেলে ছয় থেকে সাত ফুট গর্ত করে পুতে রাখতে হয়। অসুস্থ পশুর মাংস খেলে ভয়াবহ রোগ হতে পারে বলে জানান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সিরাজুল ইসলাম। অথচ কসাইরা সে মাংস বিক্রি করেন। রোগাক্রান্ত পশুর মাংস বিক্রি অন্যায় জানিয়ে তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগুলো দেখভালে আলাদা দপ্তর তৈরি করা প্রয়োজন। সেখানে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল থাকবে। তারাই পশুস্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন।
জানা গেছে, উপজেলার একাধিক স্থানে প্রতিদিন গরু, ছাগল ও ভেড়া জবাই হয়। এর মধ্যে সাদুল্লাপুর বাজার, ধাপেরহাট বন্দর, ভাতগ্রাম, নলডাঙ্গা, কান্তনগর, ঢোলভাঙ্গা, মিরপুর বাজার ও কামারপাড়া বাজার উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে কিছু হাটে সপ্তাহে দু-তিন দিন পশু জবাই হয়। তবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কেউ যায় না। এ কারণে কসাইরা নির্ভয়ে রোগাক্রান্ত পশু জবাইয়ের সুযোগ নেন।
পশু জবাইয়ের আগে ভেটেরিনারি সার্জন দিয়ে পরীক্ষা করানোর নিয়ম থাকলেও কসাই তা করেন না। তারা নিজের ইচ্ছায় মাংস বিক্রি করেন জানিয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের সার্জন ডা. আব্দুল্লাহেল কাফী বলেন, পৌরসভা এলাকায় এ চিকিৎসক নির্ধারিত। কিন্তু সাদুল্লাপুর পৌরসভা না হওয়ায় সেই সুযোগ নেই। সরকারি জবাইখানাও করা হয়নি। অথচ পশু জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত স্থান থাকা জরুরি।
যত্রতত্র পশু জবাই করায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে জানিয়ে সাদুল্লাপুর হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান লতিফ বলেন, জবাইখানা না বানিয়ে হাট ইজারা দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রচুর কুকুর আসে। সেগুলো উৎপাত করে শহরে। দিনে পথচারী এবং শিক্ষার্থীরা কুকুর আতঙ্কে থাকেন। ফজরের নামাজের সময় মুসল্লিরা কুকুরের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
কাগজে সরকারিভাবে প্রতি মঙ্গলবার সাদুল্লাপুরে মাংসবিহীন দিবস। তবে বাস্তবে প্রতিদিন পশু জবাই হয়। কসাইরা এ দিবস মানতে নারাজ। অথচ ‘পশু জবাই ও মাংসের মাননিয়ন্ত্রণ আইন’ নিয়ে গত জুন মাসে ৩০ জন কসাইকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে প্রাণিসম্পদ দপ্তর। এরপরও কসাইরা এ-সংক্রান্ত কোনো আইন মানেন না বলে জানিয়েছেন দপ্তরের কর্মকর্তারা।
প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে জানা গেছে, উপজেলায় তিন হাজার ৬৭৭ খামারে গরু আছে এক লাখ ৯৯ হাজারের বেশি। দুই হাজার ৫১ খামারে ৮৩ হাজারের বেশি ছাগল আছে। ভেড়া আছে ৮ হাজার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খামারি বলেন, কসাইরা যোগাযোগ রাখেন। পশু অসুস্থ হলে কেনেন। এতে খামারিরা ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেন। কসাই অল্প দামে পশু কিনে লাভবান হন। অনৈতিক হলেও অধিকাংশ খামারি ও কসাই এ কাজ করেন।
উপজেলায় বছরে মাংসের চাহিদা ১৪ হাজার ৫০০ টন। মাছের চাহিদা ৬ হাজার ৩৮৭ টন।
তবে চাহিদার তুলনায় ১ হাজার ৬৬৬ টন
মাছের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে মাংসের চাহিদা বেশি বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ দপ্তর। তাদের মতে, বাঙালির বেশি পছন্দ গরু-ছাগলের মাংস। তাই বিক্রেতারা এসব হাতের নাগালে রাখেন। ক্রেতারা সচেতন না হলে রোগাক্রান্ত পশুর মাংস কেনার আশঙ্কা থাকে।
কয়েকজন কসাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা একই সুরে কথা বলেন। তারা কেউ রোগাক্রান্ত পশু জবাই করেন না বলে দাবি করেন। তবে জবাইয়ের আগে প্রাণিসম্পদ দপ্তরকে না জানানোর বিষয়টি স্বীকার করেছেন। প্রশিক্ষণ নিয়েও কেন আইন অমান্য করেন– এমন প্রশ্নে তারা বলেন, সরকারি তদারকি থাকলে মানতে বাধ্য হতেন। কর্তৃপক্ষ ঢিমেতালে চলায় তারাও গাছাড়া দিয়েছেন।
হাট-বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও ইউএনও কাওছার হাবিব বলেন, সরকারি তালিকাভুক্ত ১৯টি হাট-বাজার একসঙ্গে তদারকি প্রায় অসম্ভব। তাই সচেতন হতে হবে ক্রেতাদের। কোনো বিষয়ে অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত পশু জবাইবিরোধী অভিযান চালাতে সুবিধা হবে। প্রশাসনকে জানালে হাতেনাতে ধরা যায় অসাধু কসাইদের।
- বিষয় :
- মাংস