ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বন থেকে বিলুপ্ত প্রায় পশুপাখি

বন থেকে বিলুপ্ত প্রায় পশুপাখি

ফাইল ছবি

মাসুম মিয়া, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল)

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:২০

বনে পশুপাখি থাকবে, থাকবে নানা কীটপতঙ্গ। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে চলবে বাস্তুসংস্থান। কিন্তু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কৃত্রিমতার ছোঁয়ায় ধ্বংসের দারপ্রান্তে প্রাকৃতিক পরিবেশ। সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করায় বিলুপ্তপ্রায় পশুপাখি। যার প্রভাব পড়ছে বাস্তুসংস্থান চক্রে। এমন চিত্র লক্ষ্য করা যায় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল বনাঞ্চলে।
ঘাটাইলের উপজেলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূমি ছোট-বড় অসংখ্য টিলা দিয়ে গঠিত। টিলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বনাঞ্চল, যা ছিল গাছপালায় ঘেরা ঘন জঙ্গল। এক সময় মাথা উঁচু করে এই বনে রাজত্ব করত শাল-গাজারি। সঙ্গে ছিল আমলকী, হরীতকী, বহেরা, অর্জুন, তিতিজাম, আনাইগোটা, খেঁজুর, বট, শিমুল, ছাগলনাদি, চুকাইগোটা, জয়নাগোটা, পিতরাজসহ নাম না জানা নানা বৃক্ষ। এসব বৃক্ষের সঙ্গে মিতালি ছিল বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আর প্রাণীর। তিন যুগ আগেও বন্যপ্রাণীর ছোটাছুটি আর পাখির কলকাকলিতে মুখর ছিল এ অঞ্চল। কিন্তু বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম আঘাত হেনেছে প্রাকৃতিক এ বনভূমিতে। বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ১৩ প্রজাতির দেশি গাছ। বনে বিদেশি গাছের আগমনে খাদ্য ও বাস্তুসংস্থান সংকটে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে পাখি। বনে সারাদিন ঘুরে দু-চারটি শেয়াল ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর দেখা মেলা ভার। তবে বন কর্মকর্তার দাবি, কিছু পাখি বাসা বাঁধে। আর শেয়াল, সজারু এবং বানরের দেখা পাওয়া যায় কিছু এলাকায়।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ঘাটাইল উপজেলায় বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। নব্বইয়ের দশকে ‘সামাজিক বনায়ন’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করে বন বিভাগ। এই কর্মসূচির বলি হয় এখানকার প্রাকৃতিক বন। বর্তমানে সামাজিক বনায়নের দখলে প্রায় ১৫ হাজার একর বনভূমি। যার পুরোটাই একটা সময় ছিল প্রাকৃতিক বন।
সামাজিক বনায়ন ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ জায়গা দখল করে আছে বিদেশি বৃক্ষ। যার মধ্যে রয়েছে আকাশমনি, মিনজিয়াম, ইউক্যালিপটাস। দেওপাড়া মালেঙ্গা এলাকায় আকাশমনি গাছের বাগানের পাশ দিয়ে বিকেলে গরুর পাল নিয়ে যাচ্ছিলেন আদিবাসী নারী সীমা রানী। তাঁর ভাষ্য, বিদেশি এই গাছের তেমন কোনো ডালপালা নেই, ফল নেই। বীজের স্বাদ তেতো। পাতা বিষাক্ত। পাতা এতটাই বিষাক্ত যে, ওইসব গাছের নিচে ঘাস পর্যন্ত জন্মায় না। বাগানের পাশেই টিলার ঢালুতে (বাইদ) আমন ধানের জমিতে পরিচর্যা করছিলেন কৃষক আবদুর রাজ্জাক। পরিচর্যা বলতে আকাশমনি গাছের ঝরাপাতা ক্ষেত থেকে তুলে দূরে ফেলছিলেন। গাছের পাতা পচে তো জৈবসার হবে, তাহলে ফেলে দিচ্ছেন কেন– এমন প্রশ্নে তার উত্তর, এই গাছের পাতা জমিতে পড়লে ফসল পুড়ে যায়। পাতা বিষাক্ত, পচে না।
সীমা রানী ও আবদুর রাজ্জাকের কথার সত্যতা মেলে সৃজন করা বাগানের ভেতর প্রবেশের পর। গাছের নিচে যে স্থানে পাতা ঝরে পড়ে আছে, সেখানে ঘাস বা আগাছা জন্মায়নি। আধাঘণ্টা হাঁটার পরও চোখে পড়েনি কোনো পাখি ওড়ার দৃশ্য। গাছে পাখির বাসারও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
দেওপাড়া গ্রামের কৃষক হারুন মিয়া জানান, পাখি ফসলি জমির ক্ষতিকর পোকা খেয়ে থাকে। কিন্তু এলাকায় পাখি কমে যাওয়ায় পোকা দমনে ক্ষতিকর কীটনাশকের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
হারুন মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে সূর্য। সন্ধ্যা না নামতেই দূর থেকে ভেসে আসে শেয়ালের হাঁক। এ হাঁকডাক বনে নয়, লোকালয়ে। মাকড়াই গ্রামের বাদল খান বলেন, বনে খাদ্য সংকট। সন্ধ্যা হলেই গ্রামের দিকে পথ ধরে শেয়াল হানা দেয় গৃহস্থের খামারে। কখনও আবার ছাগল-ভেড়া ধরে টানাটানি শুরু করে। অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে মানুষ পিটিয়ে মারে শেয়াল। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, খাদ্যাভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বন থেকে বিলুপ্ত হবে প্রাণীটি।
বন ভেদ করে চলে গেছে ঘাটাইল-সাগরদীঘি সড়ক। গত মাসে এই সড়ক ধরে যাওয়ার পথে শুকনি নামক স্থানে তীব্র দুর্গন্ধ অনুভূত হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে পচন ধরা মৃত শেয়ালের দেহ থেকে। পথচারী বিল্লাল হোসেন বলেন, বনে কোনো প্রাণী মারা গেলে শেয়াল ছাড়া আর কোনো প্রাণী নেই মরদেহ খাওয়ার। শেয়ালের মাংস শেয়াল তো খায় না। আর কাক তো দূরের কথা, কোনো পাখিই এই গাছে বাসা বাঁধে না। পাহাড়ি মানুষের দাবি, সামাজিক বনায়ন করার আগে বাঘ, মেছোবাঘ, বনশূকর, হাতি, বানর, সজারুসহ বিভিন্ন প্রাণী এবং প্রায় ৩০ প্রজাতির পাখি দেখা যেত এই বনে।
ঘাটাইল বন বিভাগের তথ্যমতে, এখানে সুফল প্রকল্পটি চালু হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ছয়টি বিটের মধ্যে প্রাথমিকভাবে বটতলী এবং ধলাপাড়া বিটে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। লাগানো হয় এক লাখ বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছ। এসব গাছ লাগানো হয়েছে প্রাকৃতিক বনের ভেতর। শাল-গজারি গাছের নিচে। এদিকে ‘সুফল’ নামে এই প্রকল্পের কার্যক্রম ভাবিয়ে তুলছে স্থানীয়দের। তাদের শঙ্কা, এই প্রকল্পই এক দিন কাল হয়ে দাঁড়াবে প্রাকৃতিক বনে অবশিষ্ট থাকা শাল-গজারির জন্য।
কুশারিয়া গ্রামের মনোয়ার হোসেন সোহেল বলেন, গজারি গাছের নিচে অন্য গাছের চারা রোপণ করার সময় জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। ফলে বনে অবশিষ্ট থাকা পশু-পাখি বিদায় নিয়েছে। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শেফালি বেগম সমকালকে বলেন, ‘আমি অবশ্যই সামাজিক বনায়নের বিপক্ষে। প্রাকৃতিক বন ছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট কোনো বনে পাখি এবং প্রাণী বাস করতে পারে না। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়ন করার ফলে বাসস্থান এবং খাদ্য সংকটে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশি বৃক্ষ, পাখি এবং প্রাণিকুল। ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে বনের বাস্তুসংস্থান।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন বলেন, প্রাকৃতিক এই বনে প্রায় ১০০ প্রজাতির বৃক্ষ ছিল। ছিল বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী। যা ছিল বনের সৌন্দর্য। সামাজিক বনায়ন করার ফলে প্রকৃতিকে বিবেচনা করা হয়নি। জীববৈচিত্র্যকে বিবেচনা করা হয়নি। এভাবে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার ফলে বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়ে গেছে।
ঘাটাইল বন বিভাগের ধলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা ওয়াদুদুর রহমানের ভাষ্য, এখন মিশ্র গাছের বাগান করা হচ্ছে। লাগানো হচ্ছে গামার, গর্জন, কদম, চাপালি বৃক্ষ। এর পরও সামাজিক বনায়নে উপকারভোগীদের আগ্রহের কারণে বিদেশি গাছ লাগানো হয়। তাঁর দাবি, কিছু পাখি বাগানে বাস করে। শেয়ালের দেখা সব জায়গায়ই মেলে। 

আরও পড়ুন

×