ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

ভুয়া বিল ভাউচারে হরিলুট

ভুয়া বিল ভাউচারে হরিলুট

বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ছবি: সংগৃহীত

পাবনা অফিস

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪ | ১১:৫৫ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৪ | ১১:৫৫

বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর জন্য বরাদ্দ ওষুধ বেশি দামে বাইরে বিক্রি, এসি মেরামত, স্বেচ্ছাসেবীদের বরাদ্দসহ কয়েকটি খাত থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব অর্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জান্নাতসহ কয়েকজন কর্মচারী হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ থেকে জানা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৫টি ফ্রিজ মেরামত বাবদ ফরিদপুর উপজেলার জে.কে. রেফ্রিজারেটরের নামে ২০ হাজার টাকার ভাউচার করা হয়। পরে একই দোকানের ভাউচারে দুটি এসির মেরামত দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে আরও ১৮ হাজার টাকা। বাস্তবে এ প্রতিষ্ঠান থেকে এসি বা রেফ্রিজারেটর মেরামত করা হয়নি। এক মাস পর একটি এসিতে পাখি ঢুকে সমস্যা দেখা দিলে কাশীনাথপুর বাজারের মেকানিক আলিম এসে মেরামত করে দিয়ে যান। তাঁর দোকানের নামে ভাউচারে ২টি এসি ও ৫টি ফ্রিজ মেরামত বাবদ ২০ হাজার টাকার ভাউচার করা হয়। 

এভাবে একের পর এক যন্ত্রপাতি নষ্ট দেখিয়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জান্নাতের স্বাক্ষরে ভুয়া ভাউচার করে টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুই জানে না। ২০২৩ সালের ৬ জুন অনুমোদন হওয়া কয়েকটি ভাউচারের সূত্র ধরে সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র। 

সাংবাদিকরা যোগাযোগ করেন আলীম রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্সের মালিকের সঙ্গে। ২২,০০০ টাকার ভাউচার তাঁকে দেখালে তিনি বলেন, ওই সময়ে আমি একটি এসি সার্ভিসিং করেছিলাম। একটি পাখি ভেতরে ঢুকে মারা যাওয়ায় এসি কাজ করছিল না। সেটি পরিষ্কার করে দিলে ভালো হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ভাউচারে দোকানের নাম, মোবাইল নম্বর সবই ঠিক আছে। কিন্তু টাকার পরিমাণটি ঠিক নেই। আমাকে ৫০০ টাকা দেওয়া হয়েছিল। 

ফরিদপুরের জে.কে রেফ্রিজারেটর সার্ভিস সেন্টারের স্বত্বাধিকারী শরিফুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমি বা আমার প্রতিষ্ঠানের কেউ কখনোই কাজ করেনি। কোনো বিলও আমি করিনি। 

এ ছাড়া করোনাকালে স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বরাদ্দ সম্মানী ভাতাও নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ওই সময়ে হাসপাতালে কর্মরত নাইটগার্ড, আনসার সদস্য ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বেচ্ছাসেবী দেখিয়ে এক বছরে তুলে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টাকা। একই ব্যক্তিকে চম্পা ও চামেলি আলাদা নাম দেখিয়েও তোলা হয়েছে টাকা। 

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বরত আনসার সদস্য জুয়েল রানা স্বেচ্ছাসেবী ভাতা হিসেবে কিছু টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। সরকারি দায়িত্বে থেকেও স্বেচ্ছাসেবী হতে পারেন কিনা জানতে চাইলে সদুত্তর দিতে পারেননি। এ সময় একাধিক নাম ব্যবহার করা স্বেচ্ছাসেবক ভাতা পাওয়া চামেলি খাতুন চম্পা সটকে পড়েন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী বলেন, চম্পা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিশ্বস্ত লোক। আউটসোর্সিং হিসেবে কাজ করেন। স্বেচ্ছাসেবী ভাতার টাকা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তাঁর মতো কয়েকজন অনুসারীকে আত্মসাৎ করেছেন।

এদিকে, হাসপাতালের সেবার মান নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই স্থানীয়দের। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও নাগাল পাওয়া যায় না। এক্স-রে, ইসিজি ও সাধারণ প্যাথলজি পরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও রোগীদের পাঠানো হয় আশপাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। বিনামূল্যের ওষুধ, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজও কিনতে হয় বাড়তি দামে। প্রতিবাদ করলেই দুর্ব্যবহার ও হয়রানি করা হয়। 

রোগীর স্বজন আবুল মালিথা বলেন, আমাশয়ের ট্যাবলেট ছাড়া এখানে কিছু মেলে না। এক টুকরা ব্যান্ডেজও বাইরে থেকে আনতে হয়। আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে শুনেছি। একটাও পরীক্ষা এখানে হয় না। হাসপাতালের লোকই দালাল ধরিয়ে দেয়। 

সুজন, হাফিজ ও আশফাকসহ কয়েকজন বলেন, এখানে একটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এর কোনো সেবা রোগীরা পায় না। অথচ প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা রমরমা। 

স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফাতেমাতুজ জান্নাতের দাবি, ষড়যন্ত্র করে তাঁর নামে দুর্নীতির অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে ভুয়া বিল ভাউচার দেখালে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। স্বেচ্ছাসেবকের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, করোনাকালে লোকবল না থাকায় কর্মীদের স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করানো হয়েছে। তাই তাদের বরাদ্দের ভাতা দেওয়া হয়েছে।

পাবনার সিভিল সার্জন শহীদুল্লাহ দেওয়ান জানান, যেসব বিল ভাউচারের কথা বলা হচ্ছে, তা আমার যোগদানের আগের। হাসপাতালের কর্মীদের স্বেচ্ছাসেবক ভাতা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তা সুস্পষ্ট অনিয়ম। অভিযোগ সত্য হলে প্রয়োজনে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×