শাহানারা-শরিফাদের যুদ্ধ শেষ হয় না

খুলনার কয়রায় নদী থেকে মাছের রেণু সংগ্রহ করছেন এক নারী। নদী-তীরবর্তী ও সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় জীবিকা নির্বাহে সংগ্রামরত এমন অনেক নারীকে দেখা যায়। সোমবার তোলা সমকাল
শেখ হারুন অর রশিদ, কয়রা (খুলনা) ও সামিউল মনির, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা)
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:৪১
খুলনার কয়রা উপজেলার কাঠমারচর গ্রামের পাশে কপোতাক্ষ নদের তীরে বসবাস শরিফা খাতুনের। নদে জাল টেনে বাগদার রেণু ধরেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে জানতে পারেন, স্বামীর আরেকটি বউ আছে। তার পরও সাংসারিক চাপ সামলে স্বামীর সঙ্গেই ছিলেন শরিফা। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই মা হন। এভাবে অল্প বয়সেই একে একে তিন সন্তানের জন্ম দেন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গেলে শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে হয় শরিফাকে। কিন্তু বাবার বাড়িতে এসেও শান্তি ছিল না। ভাই-ভাবিদের চাপে বিরোধ তৈরি হয় তাঁকে নিয়ে। এ অবস্থায় নদী-তীরবর্তী বাঁধের ওপর দোচালা ঘর বেঁধে সেখানেই তিন সন্তান নিয়ে শুরু হয় তাঁর টিকে থাকার যুদ্ধ। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে আর তাদের লেখাপড়া করাতে যোদ্ধা এই নারী আজও রাত-দিন কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। গত ১৫ বছর নদীর সঙ্গে সখ্য গড়ে টিকে আছেন তিনি।
শুধু শরিফা নন, কয়রার নদী-তীরবর্তী ও সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় গেলে এমন আরও যোদ্ধা নারীর দেখা পাওয়া যায়। সমাজ-সংসারের নানা চাপ সামলে তারা একা যুদ্ধ করে টিকে আছেন। ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনে দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে সংসারে তারাই হয়ে ওঠেন পরিবারপ্রধান।
সুন্দরবন-সংলগ্ন আরেক উপকূলীয় জনপদ সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর। উপজেলার নীলডুমুর গ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব শাহানারা বেগম জানান, দুই ছেলে আর এক মেয়েসহ পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্বামীকে নিয়ে তাঁর সংসার। চার বছর আগে স্বামী আবদুস সাত্তার মোল্যা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে একাই সংসারের ঘানি টেনে চলেছেন। পাশের খোলপেটুয়া নদীতে মাছের রেণু শিকারসহ এলাকায় নারী শ্রমিকের কাজ করে রোজগার করেন তিনি। শাহানারা বলেন, ‘খুব কষ্টে আছি। জাল টেনে, মজুর খেটে দিন কাটে। কোনোদিন খাইয়ে, আবার কোনোদিন না খাইয়ে দিন যায়। মাঝেমধ্যি তিন সাজ আড়ে এক সাজ খাই, দুই সাজ খাইনে। কাল (রোববার) দুপুরিও ঘরের কারও খাবার জোটেনি।’
প্রান্তিক এই গ্রামীণ নারীদের যুদ্ধ হয়তো স্বীকৃতি পায় না। কিন্তু পরিবার ও সমাজের জন্য তাদের শ্রম ত্যাগ অবশ্যই স্বীকৃতির দাবি করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে সারাবিশ্বে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস’। বাংলাদেশেও ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবার দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘জলবায়ু অভিঘাতজনিত দুর্যোগে নারীদের শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা ও সক্ষমতা নিশ্চিতকরণ’।
তবে কয়রা বা শ্যামনগরের মতো প্রান্তিক উপকূলীয় এলাকাগুলোতে এ দিবসে তেমন কোনো কর্মসূচি না থাকায় নারীরা জানতেই পারেন না দিনটির কথা। শ্যামনগরের বেশ কয়েকজন শ্রমজীবী নারী জানান, আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। এই দিবসকে কেন্দ্র করে নারীদের অধিকার ও ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করার যে চেষ্টা করা হয়, সেই বিষয়েও তারা একেবারে অন্ধকারে।
কয়রার সুন্দরবন-সংলগ্ন তেঁতুলতলারচর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার নারীরা ছোট নৌকায় করে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে ফিরছেন। এই নারীরা জানান, সুন্দরবনে প্রবেশে তাদের বন বিভাগের অনুমতিপত্র নেই। তবু পেটের তাগিদে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গিয়েছিলেন কাঁকড়া শিকারে। কিন্তু বন বিভাগের লোকজন তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। বাসন্তী রানী বলেন, ‘এলাকায় এখন কাজ নেই বললেই চলে। বাড়ির পাশে সুন্দরবন আছে বলি সেখান থেকি কমবেশি আয়-রোজগার করে কোনোরকমে বাঁচি আমরা। সুন্দরবন না হলি কী যে হতো, ভগবানই জানেন।’
কয়রা উপজেলা পরিসংখ্যন অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেখানে নারী শিক্ষার হার ১৫ শতাংশ। বেশির ভাগ নারীর কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এমন অবস্থা বলে জানা গেছে। গত এক বছরে এ উপজেলায় অর্ধশতাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। তবে তথ্য গোপন করে বেশির ভাগ বাল্যবিয়ে সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া ৫৭ শতাংশ নারী শ্রমজীবী; যারা পুরুষের পাশাপাশি পরিবারের উপার্জনে ভূমিকা রাখেন।
শ্যামনগরে গ্রামীণ নারীদের নিয়ে কাজ করা এনজিও প্রেরণ-এর নির্বাহী পরিচালক শম্বা গোস্বামী বলেন, আগের তুলনায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের মধ্যে এখনও গ্রামীণ নারী দিবসের ধারণা পৌঁছায়নি। প্রতিদিনই গ্রামীণ নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের এখনই ভাবতে হবে তৃণমূলের নারীদের নিয়ে।
- বিষয় :
- মাছের ডিম