ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

১৫ বছরে খুলনা নগরীর সমান কৃষিজমি ভরাট

আবাসনের নামে কৃষিক্ষেতে আ’লীগ নেতাদের থাবা

একটি আবাসন প্রকল্পেরও অনুমোদন নেই

আবাসনের নামে কৃষিক্ষেতে আ’লীগ নেতাদের থাবা

কোলাজ

হাসান হিমালয়, খুলনা

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৪৯ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৪ | ০৮:২৪

২০১০ সালেও খুলনা থেকে সাতক্ষীরা, কৈয়া কিংবা বটিয়াঘাটা সড়কের দু’পাশে চোখে পড়ত অবারিত ধানক্ষেত। গত ১৫ বছরে সেই দৃশ্য বদলে গেছে। এখন সড়কের দু’পাশে অসংখ্য স্থাপনা। যেটুকু ফাঁকা রয়েছে, সেখানে ঝুলছে আবাসন কোম্পানির সাইনবোর্ড। আশপাশের অলিগলি, সংযোগ সড়কের দৃশ্যও একই। 

খোলা চোখে আবাসন ব্যবসায়ীদের এসব কাজ স্বাভাবিকই মনে হয়। কিন্তু আড়ালে চলছে কোটি কোটি টাকার খেলা। অস্ত্র আর পেশিশক্তির ঝনঝনানি। জাল কাগজ তৈরি করে জমি দখল, দরিদ্র কৃষকদের জমি বিক্রিতে বাধ্য করা, সরকারি খাল ভরাট করে আবাসন প্রকল্প তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে প্রতিবছর এখানে শত শত কোটি টাকা হাতবদল হয়। গত ১৫ বছর ধরে এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল গুটি কয়েক আওয়ামী লীগ নেতার হাতে। 

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আবাসন ব্যবসার মাধ্যমে প্রভাবশালীরা কোটি টাকার মালিক হলেও দিন দিন নিঃস্ব হচ্ছেন এলাকার কৃষক। খাল ভরাট করায় শোলমারী এলাকার ২৩টি গ্রাম পানির নিচে ডুবে ছিল দীর্ঘদিন। কৃষিজমি রক্ষা এবং আবাসন কোম্পানি তৈরির জন্য আইন থাকলেও পদে পদে তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। খুলনায় ৯৪টি আবাসন প্রকল্পের একটিরও নিবন্ধন নেই। ঘুষ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে সরকারি দপ্তরগুলো।

সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জমি কেনাবেচা এবং দখলের সঙ্গে শতাধিক ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। এর মধ্যে শীর্ষ ১০ জন হলেন– গোপালগঞ্জ জেলা কল্যাণ সমিতির সভাপতি শেখ আবেদ আলী, যুবলীগ নেতা হাফিজুর রহমান হাফিজ, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আজগর বিশ্বাস তারা, তানিসা হাউজিংয়ের শফিকুল ইসলাম, বটিয়াঘাটা থানা আওয়ামী লীগ নেতা আসলাম তালুকদার, জলমা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আশিকুজ্জামান আশিক, জলমার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল আজিজ, যুবলীগ নেতা নাজমুল হোসেন ও ব্যবসায়ী আবদুল কাদের। 
জমি হাতবদল করে প্রত্যেকে এখন শতকোটি টাকার মালিক। 

যেভাবে শুরু
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে সাতক্ষীরা সড়কের দু’পাশের পুরোটাই ছিল কৃষিজমি ও জলাশয়। ২০০৫ সালের ২১ মে খানজাহান আলী সেতু (রূপসা সেতু) নির্মাণ করা হয়। সেতুতে চলাচলের জন্য আফিলগেট থেকে কুদির বটতলা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হয়। খুলনা শহর বাইপাস নামে পরিচিত সড়কটি খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের মাঝ দিয়ে চলে গেছে। দুটি সড়কের মিলনস্থলের নাম হয় জিরো পয়েন্ট। ২০০৭ সাল থেকে জিরো পয়েন্টকে কেন্দ্র করেই খুলনা নগর সম্প্রসারণ শুরু হয়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রূপসা সেতু বাইপাস সড়কটি নির্মাণের জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল, তাদের অন্যতম ব্যবসায়ী শেখ আবদুল কাদের। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার হাত থেকে জমি অধিগ্রহণের চেক নেন তিনি। সেই টাকা দিয়ে জমি কিনে প্লট আকারে বিক্রি শুরু করেন। তাঁর হাত ধরেই এখানে আবাসন ব্যবসার গোড়াপত্তন বলা যায়। 
পরবর্তী সময়ে শেখ আবেদ আলীসহ অনেকে অল্প দামে জমি কিনে চড়া দামে প্লট আকারে বিক্রি শুরু করেন। রাতারাতি জমির দামও বেড়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর জমি কেনাবেচায় পেশিশক্তি এবং রাজনৈতিক দখলদারিত্ব শুরু হয়।  

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ১০ বছরে খুলনায় ৭১৩ হেক্টর বা ৪ হাজার ৯৯১ বিঘা কৃষিজমি আবাসন ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। তবে বাস্তবে এর পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি। 
২০২০ সালের অক্টোবর ‘খুলনা : প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা জনবসতি বৃদ্ধির বৈচিত্র্য ও বিভাজন’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তানজিল সওগাত ও ড. শিল্পী রায়। এতে বলা হয়, গত ৩০ বছরে খুলনা শহর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ১৭ দশমিক ৭৪ বর্গকিলোমিটার সম্প্রসারিত হয়েছে। শহর ও সম্প্রসারিত এলাকায় ৪ দশমিক ৬৬ বর্গকিলোমিটার জলাশয়, ১ দশমিক ৮৪ বর্গকিলোমিটার গাছপালা এবং ৪১ দশমিক ৬৬ বর্গকিলোমিটার চাষাবাদযোগ্য জমি নষ্ট হয়েছে। মোট কৃষিজমি কমেছে প্রায় ৪৯ শতাংশ। 
খুলনা মহানগরীর বর্তমান আয়তন ৪৫ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ, গত ৩০ বছরে প্রায় খুলনা শহরের আয়তনের সমান কৃষিজমি নষ্ট হয়েছে। 
গবেষণাটির ফলাফলের সত্যতা পাওয়া যায় স্যাটেলাইটের ছবিতে। চলতি শতকের শুরু থেকে গত জুলাই মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা স্যাটেলাইটের ছবিগুলো ঘেঁটে দেখা যায়, ২০০১ সালে নগরীর জিরো পয়েন্ট এলাকার চারপাশে পুরোটাই ছিল কৃষিজমি। ২০১০ সালেও একই দৃশ্য দেখা গেছে। ২০১৬ সালে কিছু অংশে বাড়িঘর তৈরি শুরু হয়। আর ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ওই এলাকায় কৃষিজমি খুঁজে পাওয়াই কঠিন।
গবেষক দলের সদস্য ড. শিল্পী রায় বলেন, ‘পেশিশক্তির প্রয়োগ এবং আইন না মানার প্রবণতার কারণেই শহরের বাইরের অংশে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে।’

জমিতে রাজনীতি ও পেশিশক্তি
খুলনায় বর্তমানে ৯৪টি আবাসন প্রকল্প রয়েছে। বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ নেতাদের মালিকানায়। এর বাইরে অরাজনৈতিক একটি গোষ্ঠী রয়েছে, যারা নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করে জমি দখল, খালবিল ভরাটের পর বিক্রি করে। 
গত ১৫ বছর আবাসন ব্যবসার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সম্পদ গড়েছেন শেখ আবেদ আলী। বাইপাস সড়কের পাশে সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প ‘গুলজান সিটি’র মালিক তিনি। পুঁটিমারী ও তেঁতুলতলা বিলেও আবাসন ব্যবসা রয়েছে তাঁর। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি তিনি। তাঁর প্রকল্পের ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে তৈরি হচ্ছে খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া খুলনা-মোংলা রেললাইনের একাংশ, হরিণটানা থানা এবং ওয়াসার ক্যাম্প অফিসও তাঁর জমিতে। 
গোপালগঞ্জ জেলা কল্যাণ সমিতির সভাপতি হিসেবে বিগত সরকারের সময় নানাভাবে সুবিধা নিয়েছেন তিনি। তাঁর মালিকানাধীন ‘গুলজান সিটি’ তৈরির সময় বহু মানুষের জমি দখলের অভিযোগ ওঠে। ৫ আগস্টের পর তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। বর্তমানে তিনি সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। তাঁর বক্তব্য নেওয়ার জন্য খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। 

পেশিশক্তির মাধ্যমে গত ১৫ বছর আবাসন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন মহানগর যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজুর রহমান হাফিজ। অন্যের হয়ে জমি দখলের সালিশ বৈঠকে তাঁর নামটি আসে সবার আগে। তবে নিজের নামে খুব কমই জমি কিনেছেন হাফিজ। 
হাফিজের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে জমি কেনাবেচা করতেন আশিকুজ্জামান আশিক, আসলাম তালুকদার ও আবদুল আজিজ। বেশির ভাগই বিতর্কিত জমি। ৫ আগস্টের পর হাফিজের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হয়েছে। আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। 

আরেকটি বড় আবাসন কোম্পানির নাম ‘বিশ্বাস প্রপার্টিজ’। নগরীর রায়ের মহল, বিল পাবলা, কৈয়া, রাজবাঁধসহ সাতটি স্থানে তাদের প্রায় দেড় ডজন আবাসিক প্রকল্প রয়েছে। বিতর্কিত ও ঝামেলাযুক্ত জমি কিনে বালু ভরাট করে বিক্রি করাই তাদের প্রধান কাজ। কোম্পানির মালিক আজগর বিশ্বাস তারা ওরফে তারা বিশ্বাস জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। জমি কিনে টাকা না দেওয়া, টাকা নিয়ে প্লট না দেওয়া, তিন বিঘা জমি কিনে পাঁচ-সাত বিঘায় বালু ভরাট করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে একাধিক মামলাও হয়েছে। 
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই একটি হত্যা মামলায় তারা বিশ্বাস গ্রেপ্তার হন। ৫ আগস্ট তাঁর কার্যালয়ে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পরে একাধিক মামলা হয়েছে তারা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে। জামিনে মুক্তি পেয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। 

আরেক বড় আবাসন প্রতিষ্ঠান ‘তানিসা এন্টারপ্রাইজ’। নগরীর বিভিন্ন স্থানে তানিসা আবাসিক প্রকল্প নামে প্লট ব্যবসা করছে তারা। কোম্পানির মালিক শফিকুল ইসলাম এতদিন খালিশপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফয়েজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করেছেন। গত ৫ আগস্টের পর নিজেকে ‘বিএনপির লোক’ দাবি করে বিশ্বাস প্রপার্টিজের বেশ কিছু জমি দখলে নেন। 
শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, জমি দখল বা বিতর্কিত জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিযোগ সঠিক নয়।
এ ছাড়া জলমা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আশিকুর রহমানও বড় আবাসন ব্যবসায়ী। ‘সিয়াম হাউজিং প্রকল্প’ নামে রাজবাঁধ, দারোগাভিটা, হোগলাডাঙ্গা, প্রগতি স্কুলের সামনে এখনও জমি কেনাবেচা করছেন তিনি। আশিক বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগের পুরোটা সময় যুবলীগ নেতা হাফিজের সঙ্গে অংশীদারের ভিত্তিতে ব্যবসা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও জমিসংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে।

আশিকের দাবি, ‘এসবের বেশির ভাগই ভুয়া মামলা। আর কারও সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা করা তো অন্যায় নয়।’
আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে ভ্যান চালাতেন বটিয়াঘাটা থানা আওয়ামী লীগের সদস্য আসলাম তালুকদার। জমির ব্যবসা করে তিনি এখন বিপুল টাকার মালিক। হোগলাডাঙ্গা, নিজ খামার বিদ্যুৎ অফিসের সামনে এবং বটিয়াঘাটার ওপারে বড় প্রকল্প রয়েছে তাঁর। তিনিও হাফিজের ব্যবসায়িক অংশীদার। আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
খুলনার সবচেয়ে পুরোনো জমি ব্যবসায়ী শেখ আবদুল কাদের। জিরো পয়েন্ট এলাকার ‘রূপসী রূপসা’ আবাসন করতে গিয়ে সরকারি খাল ভরাট করে আলোচনায় আসেন তিনি। ওই প্রকল্পের ৮০ বিঘা জমির মধ্যে প্রায় ২০ বিঘাই ছিল সরকারি খাসজমি। সেখানে ভূমিহীনরা বসবাস করতেন। তাদের উচ্ছেদ করে প্রকল্পটি করা হয়। নগরীর জিরো পয়েন্ট এলাকার তিন পাশের মার্কেটে দোকানপাটসহ বেশির ভাগ জমির মালিক তিনি। এই সম্পদের মূল্যই এখন ৫০০ কোটি টাকা।

হাফিজের চাচা ও জলমা ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল আজিজও এই খাতের বড় ব্যবসায়ী। আবদুল আজিজ, আসলাম তালুকদার ও হাফিজ মিলে নিজ খামার মোড়ে রূপনগর আবাসিক নামে একটি আবাসন প্রকল্প তৈরি করেন। প্রকল্পের রাস্তা তৈরির জন্য সরকারি খাল ভরাট করা হয়, দখল করা হয় খাসজমি। আবদুল আজিজও এখন আত্মগোপনে।
২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জিরো পয়েন্ট এলাকায় প্রভাবশালী জমি ব্যবসায়ী ছিলেন যুবলীগ নেতা নাজমুল হোসেন। খুলনা-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিজানের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক জমি দখল করে আলোচনায় আসেন তিনি। এক পর্যায়ে ভাষাসংগ্রামী সমির আহমেদের জমি দখল নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিছুদিন পরই মাদকসহ গ্রেপ্তার হন নাজমুল। এর পর ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। ততদিনে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা।

আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি, ঘুষে নীরব কেডিএ
আবাসন কোম্পানি পরিচালনার জন্য খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) কাছ থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। কিন্তু খুলনায় এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কোনো প্রকল্পের নিবন্ধন নেই।
ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা-২০০৪ এর তৃতীয় অধ্যায়ের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, বেসরকারি আবাসিক প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন বা পৌর এলাকার বাইরে ন্যূনতম ১০ একর জমি প্রয়োজন হবে। ৯ ধারায় বলা হয়েছে, প্রকল্প এলাকার জমির সর্বোচ্চ ৭০ ভাগ উন্নয়নকৃত জমি বিক্রয়যোগ্য হবে। বাকি ৩০ ভাগ জমি সম্পূর্ণভাবে অবিক্রয়যোগ্য বলে গণ্য হবে।
রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধন ছাড়া আবাসন ব্যবসা করা যাবে না। ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ নিবন্ধন গ্রহণ না করে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনূর্ধ্ব ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ড দেওয়া যাবে।
কয়েকটি প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ১০ একর তো দূরের কথা, ৯০ শতাংশ আবাসন প্রকল্প তৈরি হয়েছে ৩-৫ বিঘা জমিতে; সর্বোচ্চ আছে ১ একর পর্যন্ত। সেখানে ৮-১২ ফুটের ইটের রাস্তা তৈরি করে প্লট আকারে জমি বিক্রি করা হচ্ছে। সড়ক বাদে জমির শতভাগই বিক্রি করা হচ্ছে।

এভাবে আবাসন কোম্পানিগুলো পদে পদে আইন ভঙ্গ করলেও তাদের বিরুদ্ধে খুব একটা ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না কেডিএকে। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং কেডিএর পরিকল্পনা বিভাগে মোটা অঙ্কের ঘুষ দেওয়া হয়। এ কারণেই মুখ বন্ধ থাকে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের। 
অবশ্য আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কেডিএর পরিকল্পনা কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ। কেন অভিযান চালানো হচ্ছে না– প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, জনবল সংকটসহ নানা কারণে প্রতি মাসে অভিযান চালানো যায় না। 

ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার রাজবাঁধ গ্রামের ঠাকুর দাস ঢালী ছিলেন সচ্ছল কৃষক। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৮ বিঘা জমিতে শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধান আর বর্ষায় মাছ চাষ করতেন। শীতে থাকত সবজি। মৌসুমে যে ধান-মাছ-সবজি পেতেন, সারাবছর খেয়েদেয়ে বিক্রিও করতে পারতেন। 
২০১৫-১৬ সালের দিকে দেখা যায়, ঠাকুর দাসের পৈতৃক সম্পত্তির আশপাশের প্রায় অর্ধেক জমি কিনে নিয়েছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। সেই জমিতে প্লট বানানোর জন্য খাল ভরাট করেন তারা। ঠাকুর দাসের জমিতে যাওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না। খালে পানি নেই। আশপাশের জমি বালু দিয়ে ভরাট করায় অন্য জমিও আর চাষের উপযোগী নেই। অনেকটা বাধ্য হয়েই ঠাকুর দাস তাঁর সব জমি বিক্রি করে দেন।
গত আগস্ট মাসে রাজবাঁধ চৌরাস্তায় বসে ঠাকুর দাস ঢালীর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি শ্রমিকের কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। সমকালকে বললেন, ‘নিজের জমি-ঘের ছিল। ইচ্ছেমতো কাজ করেছি। অভাব কী বুঝিনি। এখন সারাদিন কাজ করে যা পাই, তা দিয়ে সংসার আর চলে না।’
রাজবাঁধ গ্রামের অধিকাংশ মানুষের কষ্ট এখন একই। আবাসন ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ে পৈতৃক জমিজমা হারিয়ে তারা এখন অন্য পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু অভাব-অনটন ঘরে ঘরে। রাজবাঁধ গ্রামটি একটি উদাহরণ মাত্র। খুলনা মহানগরীর সীমান্তঘেঁষা বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের চিত্র এখন এমনই।

কেডিএ নিজেই আবাসন ব্যবসায়
মাস্টারপ্ল্যান এলাকায় ভূমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেডিএর। কিন্তু বেসরকারি কোম্পানির মতো কেডিএ নিজেই নেমে পড়েছে জমির ব্যবসায়। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কেডিএ খুলনাঞ্চলে ১০টি আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। প্রায় ৩৫০ দশমিক ৪০ একর জমিতে ৪ হাজার প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। সব প্রকল্পই বাস্তবায়ন করা হয়েছে কৃষিজমি ও জলাভূমি ভরাট করে।
জানতে চাইলে চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিরাজুল ইসলাম বিভিন্ন এলাকার স্যাটেলাইট ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্যই কেডিএ প্রকল্প নিচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে নগর সম্প্রসারণের চাইতে পরিকল্পিতভাবে আবাসন প্রকল্প নেওয়া কি ভালো নয়?’
‘কিন্তু কৃষিজমির কী হবে’– এই প্রশ্নে কোনো কথা নেই কেডিএ চেয়ারম্যানের।

খুলনার বিষফোড়া
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, একশ্রেণির জমি ব্যবসায়ী নিচু জমি কিনে কোনোমতে ভরাট করে প্লট বিক্রি করছে। লোকজন ভালোভাবে খোঁজখবর না নিয়েই জমি কিনে সেখানে বাড়ি করছেন। কয়েক বছরের মধ্যে এই আবাসন প্রকল্পগুলো খুলনার জন্য বিষফোড়া হবে।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবির উল জব্বার বলেন, আবাসন প্রকল্পগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি গড়ে উঠছে। কেডিএ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কেডিএর আইন অনুযায়ী, আবাসন প্রকল্পে কমপক্ষে ১২ ফুট চওড়া রাস্তা থাকতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ প্রকল্পেই তা নেই। ভবিষ্যতে এই এলাকাগুলো সিটি করপোরেশনের মধ্যে এলে তখন প্রশস্ত পাকা সড়ক ও ড্রেন, ডাস্টবিন রাখার জায়গা করার সুযোগ থাকবে না।

কেডিএর ভাষ্য
আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন ও তদারকির দায়িত্ব কেডিএর পরিকল্পনা বিভাগের। পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. তানভীর আহমেদ বলেন, কোনো আবাসন প্রকল্পেরই অনুমোদন নেই, এমনকি তারা অনুমোদনের জন্য আবেদনও করেনি।
‘তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন’ প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, প্রকল্পগুলোকে অনুমোদন নেওয়ার জন্য কেডিএর পক্ষ থেকে একাধিকবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি এবং তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কেডিএর চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিরাজুল ইসলাম বলেন, মানুষ যাতে এসব কোম্পানির কাছ থেকে আর জমি না কেনে, এ জন্য কেডিএ ভবন, ওয়েবসাইট এবং দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সতর্কতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। 

আরও পড়ুন

×