খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
এবার দুদকের জালে সাবেক উপাচার্য ফায়েক উজ্জামান

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান
হাসান হিমালয়, খুলনা
প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৫:২৪ | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১০:৫১
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে রেকর্ড গড়েছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান। টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালনকালে তিন শতাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে দায়িত্ব ছাড়ার আগে এক মাসেই ১২৪ জনকে নিয়োগ দেন। এসব নিয়োগে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও বাণিজ্যের অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সৃষ্টি হয়েছে আলোড়ন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তে এর প্রমাণ মিললেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে এবার অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে চিঠি দিয়ে এসব নিয়োগ ও পদোন্নতির তালিকা এবং নিয়োগ কমিটির সভার কার্যবিবরণীসহ বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
এর আগে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মাহমুদ হোসেনের সময়ের নিয়োগ, পদোন্নতির অনিয়ম অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অধ্যাপক মাহমুদ হোসেন ৩ বছর উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন। অধ্যাপক ফায়েক উজ্জামানের সময়ই নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বেশি। বিষয়টি নিয়ে সমকালে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর নিয়োগের বিভিন্ন তথ্য চেয়ে চিঠি দিল দুদক।
অধ্যাপক ফায়েক উজ্জামান ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলায়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১০ সালের নভেম্বরে তাঁকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সময় কেসিসির সাবেক মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেকের সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের বিবেচনায় না নিয়ে রাজশাহী থেকে খুলনায় এনে ফায়েক উজ্জামানকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মো. সাইফুদ্দিন শাহের মেয়াদ শেষ হলে ২০১২ সালের ১ নভেম্বর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান ফায়েক উজ্জামান। ২০১৩ সালে ১০ জানুয়ারি তাঁকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরপর দুই মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যান তিনি।
সূত্র জানায়, দুই মেয়াদে তিন শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ওয়ালিউল হাসানাতের নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে দুদকের পক্ষ থেকে ইউজিসি চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে তদন্তের জন্য অনুরোধ করা হয়। ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ জুন ইউজিসি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কমিটির সদস্যরা সরেজমিনে বিষয়টির তদন্ত শুরু করেন। সে প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি।
ইতিহাস বিভাগের এক প্রভাষক নিয়োগ নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই শিক্ষার্থী মাস্টার্সে মেধাক্রমে ছিলেন ৬৩তম। নিয়োগ প্রার্থীদের মধ্যে ৫ জন ছিলেন পিএইচডি ডিগ্রিধারী। অথচ ফায়েক উজ্জামানের ছাত্র হওয়ায় তাঁকেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ২৭ জনের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। এর মধ্যে ফায়েক উজ্জামানের আত্মীয়স্বজন ১৯ জন।
প্রতিপক্ষ দমনে কঠোর ছিলেন ফায়েক উজ্জামান। তাঁর মেয়াদের শেষ দিকে বেতন-ফি কমানো, আবাসন সংকট নিরসনসহ কয়েকটি দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের জের ধরে দুই ছাত্রকে বরখাস্ত এবং তিন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ নিয়ে আন্দোলনে নামেন সারাদেশের শিক্ষকরা। কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন তিনি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরখাস্ত, বদলি ও পদোন্নতি আটকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
উন্নয়ন কাজে দুর্নীতির অভিযোগ
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন, আবাসিক হল, গ্রন্থাগার, অতিথি ভবনসহ কয়েকটি ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি আদায়ে ২০১৯ সালের শেষ দিকে উপাচার্য ফায়েক উজ্জামানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। সে বছর ডিসেম্বর মাসে ৪৫ জন শিক্ষক রেজিস্ট্রারের কাছে দুর্নীতির অভিযোগ করেন।
একাডেমিক ভবন নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণ হিসেবে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই গঠিত তদন্ত কমিটির ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বরের প্রতিবেদন তুলে ধরেন। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভবনের ছাদ সাড়ে ৫ ইঞ্চি পুরু হওয়ার কথা থাকলেও করা হয়েছে তিন থেকে সাড়ে চার ইঞ্চি। এ কারণে এক বছরেই বিভিন্ন জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং অভ্যন্তরীণ প্রকৌশলীদের ‘দুর্নীতিকে’ দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।
বিজয়-২৪ হল নির্মাণেও দুর্নীতির অভিযোগ করেন শিক্ষকরা। তারা দাবি করেন, দরপত্রে অনিয়ম করে বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানকে হল নির্মাণকাজ পাইয়ে দেওয়া হয়। দরপত্রে অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠলে ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দরপত্র বাতিল করে আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় দফায়ও জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেওয়া হয়।
শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনে বৈদ্যুতিক কাজে দুর্নীতির অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনেও অভিযোগ জানান।
বিভিন্ন শাখার ১৪ কর্মকর্তার বিষয়ে বিশেষ তদন্ত
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন কর্মকর্তার নিয়োগ ও পদোন্নতির নথি তলব করেছে দুদক। সাবেক দুই উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এসব কর্মকর্তার পদোন্নতি নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। তারা হলেন অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক মুজিবুর রহমান, প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার সঞ্জয় সাহা, উপ-প্রধান প্রকৌশলী (পরিবহন) মো. শাহ নওরোজ, উপ-রেজিস্ট্রার কৃষ্ণপদ দাস, উপ-প্রধান প্রকৌশলী সামিউল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম মনিরুজ্জামান পলাশ, কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের নাজমুল হাসিব, সহকারী রেজিস্ট্রার মঈনুল ইসলাম ও এস এম হুমায়ুন কবীর, উপ-রেজিস্ট্রার হাওলাদার আলমগীর হাদী, সিনিয়র নার্স শ্যামলী সুলতানা, সিস্টেম এনালিস্ট আসিফ রুবায়েত হোসেন, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. রুবেল আনসার, উপ-রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানী টিমের প্রধান ও খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, অনিয়ম অনুসন্ধানের জন্য টিম গঠন করা হয়েছে। আমরা নিয়োগ ও পদোন্নতির যাবতীয় নথি চেয়েছি। ৫ মার্চের মধ্যে এসব নথি দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। নথি পেলে পুরোদমে অনুসন্ধান কাজ শুরু হবে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। তাঁর বক্তব্য জানতে কয়েকবার ফোন করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
- বিষয় :
- খুবি উপাচার্য