দিনে দিনে পাওয়া সনদ-সেবা মিলছে না মাস পেরোলেও

কোলাজ
আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৫ | ০১:০৮ | আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৫ | ০৮:২৭
চট্টগ্রাম নগরের জামালখান ওয়ার্ডের মোমিন রোডের বাসিন্দা কিরণ দাশ। স্বামীকে হারিয়েছেন ১৪ বছর আগে। স্বামীর কর্মস্থল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাওয়া ভাতায় চলছে তাঁর সংসার। এ জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করেননি মর্মে সিটি করপোরেশন থেকে সনদ নিয়ে প্রতি বছর জমা দিতে হয়। সনদটির জন্য এক মাস আগে আবেদন করলেও এখনও সেটি পাননি। এ কারণে তাঁর ভাতা বন্ধ হয়ে আছে।
শুধু কিরণ দাশই নন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ওয়ার্ড কার্যালয়ে জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন, নাগরিক সনদসহ ১৭ ধরনের নাগরিক সেবা পেতে পদে পদে হয়রান হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আগে যেখানে দিনে দিনে সনদ মিলত, এখন কখনও দুই সপ্তাহ, কখনও পার হচ্ছে মাস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন মাসেও মিলছে না প্রত্যাশিত সনদ। অথচ সিটি করপোরেশনের সিটিজেন চার্টার (সেবাদান প্রতিশ্রুতি) অনুযায়ী, দুই কার্যদিবসের মধ্যে জন্মনিবন্ধন ও সংশোধিত জন্মনিবন্ধন পাওয়ার কথা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আগে সনদে সই করতেন সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর। কাউন্সিলর অপসারণের পর চসিকের ৪১ ওয়ার্ডের ৫৫ কাউন্সিলরের দায়িত্ব করপোরেশনের ১৩ কর্মকর্তার মাঝে বণ্টন করা হয়েছে। তারা নাগরিকদের আবেদন অনুমোদনে অতি সতর্ক। যাচাই-বাছাই ছাড়া সহজে নথিতে সই করছেন না। এ ছাড়া একজন কর্মকর্তা একাধিক ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকায় তাদের ওপর চাপও পড়ছে বেশি। এ জন্য নাগরিকদের বিভিন্ন সনদ পেতে দেরি হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে নগরের মোমিন রোডের ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, কেউ প্রত্যাশিত সনদ নিয়ে ফিরছেন, কেউ না পেয়ে হতাশ। তাদের একজন ওমর ফারুক কাজল। গত ১৮ ডিসেম্বর তাঁর বাবা মারা যান। ৯ জানুয়ারি তিনি ওয়ারিশ সনদের জন্য আবেদন করেন। পরদিন সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেয় ওয়ার্ড তদন্ত কমিটি। এর পর এক মাস পার হলেও তিনি ওয়ারিশ সনদ পাননি। মোছাম্মৎ তাসনিয়া বলেন, অনেক কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে। এর পরও ওয়ারিশ সনদ পেতে প্রায় তিন মাস লেগেছে।
জন্মনিবন্ধন পেতেও লাগছে দীর্ঘ সময়। মুহাম্মদ মিরাজ নামে এক ব্যক্তি ২৯ জানুয়ারি জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। তিন সপ্তাহেও তিনি জন্মনিবন্ধন পাননি। তিনি বলেন, আজ আবার যেখানে ভাড়া থাকি সেই ভবন মালিকের এনআইডির ফটোকপি জমা দিয়েছি। জন্মনিবন্ধন কখন হাতে আসে, জানি না।
ওয়ার্ডটির জন্মনিবন্ধন সহকারী উমা চক্রবর্তী বলেন, ‘কাগজপত্র ঠিক থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে জন্মনিবন্ধন পাওয়া যাচ্ছে। আবেদনকারীর নাগরিক প্রমাণে কোনো কাগজ ঘাটতি থাকলে পেতে দেরি হচ্ছে। কারণ কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই ছাড়া নথিতে সই করেন না।’ ওয়ার্ডটির দায়িত্বে আছেন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রক্তিম চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ওয়ার্ডটির সচিব জালাল আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আরও চারটি ওয়ার্ডের সনদে সই করেন। তিনি বসেন আগ্রাবাদে। আমরা লোকজনের আবেদন জমা নেওয়ার পর সপ্তাহে দুই দিন সই আনতে তাঁর কাছে যাই। প্রথম দিন আবেদন যাচাই করে নথিতে সই করেন। পরে সনদ প্রিন্ট করে দ্বিতীয় দফা সই করতে যেতে হয়।’
নগরের এসএস খালেদ রোডের ১৫ নম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ড কার্যালয়ে মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় গিয়ে জন্ম নিবন্ধন সহকারী শামীম মাহমুদকে পাওয়া যায়নি। জন্মনিবন্ধনের জন্য তাঁর কার্যালয়ে অপেক্ষা করছিলেন মো. মিশাত। তিনি বলেন, ‘গত ২ ফেব্রুয়ারি আবেদন করেছিলাম। মাঝখানে একবার এসে খবর নিয়েছি। তখনও সনদ সই হয়ে আসেনি। আজ আবার এসেছি। এসে দেখি জন্মনিবন্ধন সহকারী নেই।’ এই ওয়ার্ড থেকে মেয়ের নাগরিক সনদ নিয়ে ফিরছিলেন রুপম দাশ। তিনি বলেন, ‘গত ৩০ জানুয়ারি আবেদন করে সনদ আজ হাতে পেয়েছি।’ জানতে চাইলে ওয়ার্ডটির সচিব আবু রজীন চৌধুরী বলেন, ‘আগে নাগরিক সনদ দিনে দিনে দেওয়া যেত। কারণ কাউন্সিলররা তার ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের চিনতেন। এখন যাচাই-বাছাই করে সই করছেন কর্মকর্তারা। এ জন্য একটু দেরি হচ্ছে।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কর্মকর্তারা দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে সনদে সই করছেন। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলায় জন্মনিবন্ধনের আবেদন বেশি জমা হচ্ছে। এ জন্য কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাছাড়া যাচাই-বাছাই না করে গড়পড়তা সই করলে আইনি জটিলতা তৈরির শঙ্কা আছে। যে ওয়ার্ডগুলোতে বেশি দেরি হচ্ছে, সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিন মাসেও হচ্ছে না জন্মনিবন্ধন সংশোধন
নগরের এনায়েত বাজার গোয়ালপাড়া পুকুরপাড়ে ২২ নম্বর এনায়েত বাজার ওয়ার্ড কার্যালয়। গত ২০ নভেম্বর সেখানে জন্মনিবন্ধনের আবেদন করেছিলেন ইমতিয়াজ আলম। তিন মাস হলেও তিনি সংশোধিত জন্মনিবন্ধন পাননি। জানতে চাইলে ওয়ার্ডটির জন্মনিবন্ধন সহকারী রুমি রানী দাশ বলেন, ‘জন্মনিবন্ধন সনদ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অনুমোদন হয়ে আসতে হয়। এর পর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা অনুমোদন দেন। গত তিন মাসের আবেদন এখনও অনুমোদন হয়নি।’ একই কথা জানিয়েছেন জামালখান ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারী উমা চক্রবর্তীও। তাঁর ওয়ার্ডের ৮ জানুয়ারি থেকে সংশোধিত জন্মনিবন্ধনের আবেদন এখনও অনুমোদন হয়নি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের উপপরিচালক (স্থানীয় সরকার) মো. নোমান হোসেন বলেন, ‘আমার অধীনে সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ড ও ১৫টি পৌরসভা। প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার আবেদন জমা হয়। আমার একার পক্ষে এত আবেদনে সই করা সম্ভব নয়। তাছাড়া রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় প্রতিটি আবেদন যাচাই-বাছাই করতে হয়। ভোররাত ৪টা পর্যন্ত সই করি। চেষ্টা করি যত দ্রুত অনুমোদন দেওয়া যায়। এর পরও কারও জরুরি প্রয়োজন হলে কাগজপত্র নিয়ে আমার কার্যালয়ে এলে তাৎক্ষণিক করে দিই।’
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে সেসব নাগরিক সেবা দেওয়া হয়, এর মধ্যে অন্যতম জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন। এ ছাড়া নাগরিক, চারিত্রিক, উত্তরাধিকার (ওয়ারিশ), আয়, অবিবাহিত, দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ না হওয়া, পারিবারিক সদস্য, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সত্যায়িত সনদও দেওয়া হয়। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে মশক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের তদারকি এবং টিসিবির পণ্য বিতরণের কাজও কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে হয়ে থাকে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণকে সহায়তা করা এবং ওয়ার্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিকাংশ ওয়ার্ড কাউন্সিলর আত্মগোপনে চলে যান। এতে নাগরিক সেবা ব্যাহত হয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলরদের অপসারণ করে সরকার। পরে ৭ অক্টোবর কাউন্সিলরদের রুটিন কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় চসিকের ১৩ কর্মকর্তাকে। এতে একেকজন কর্মকর্তা সর্বনিম্ন দুটি ওয়ার্ড থেকে সর্বোচ্চ পাঁচটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করছেন।
- বিষয় :
- সনদ বাণিজ্য
- চট্টগ্রাম