২৬ কোটি টাকার বালু ৩৯ লাখ টাকায় বিক্রি

কোলাজ
আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:০৮ | আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫ | ০৯:১১
নিলাম ছাড়া সরাসরি কাউকে বালু বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম নেই। রীতি ভেঙে আওয়ামী লীগ আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ভাই এরশাদ মাহমুদ ও তাঁর শ্যালক ফয়সাল চৌধুরী রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কর্ণফুলী নদীর বালু বরাদ্দ নিয়েছেন অবিশ্বাস্য দরে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ড্রেজিং প্রকল্পের প্রতি ঘনফুট ২০ টাকা দরের বালু তারা হাতিয়েছেন মাত্র ৩০ পয়সায়। এ বালু দুর্নীতিতে সরকারের রাজস্ব গচ্চা গেছে অন্তত ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ৩৯ লাখে বালু বরাদ্দ নিয়ে সেই টাকাও সরকারি কোষাগারে জমা দিতে গড়িমসি করেন এরশাদ। ক্ষমতার পালাবদলের পর আত্মগোপনে থেকে ইউএনওকে ম্যানেজ করে ১৭ সেপ্টেম্বর কোষাগারে সেই নির্দিষ্ট টাকা জমা দেওয়া হয়।
এই অনিয়মে এরশাদ ও ফয়সালের সঙ্গে হাত মেলান ঠিকাদার সালাউদ্দিন চৌধুরী। তাদের প্রশাসনিক সহায়তা দেন রাঙ্গুনিয়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান মেহেবুব ও বর্তমান ইউএনও মাহমুদুল হাসান। পানির দামে বালু বরাদ্দের ধাপে ধাপে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। শঠতা ও কারসাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা সরকারের কোষাগারের বদলে চলে যায় চক্রের পকেটে। খুচরা বাজারে কর্ণফুলীর বালুর চাহিদা বেশি থাকায় তা প্রতি ঘনফুট ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় সেখানেও কয়েক কোটি টাকার লাভ নেয় তারা। ১৭ বছর এককভাবে এরশাদ মাহমুদ পুরো রাঙ্গুনিয়ার শত শত কোটি টাকার বালু সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হারানোর পর কর্ণফুলী নদী থেকে অবৈধভাবে তোলা ২০ হাজার ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়। সেপ্টেম্বরে প্রকাশ্য নিলামে এ বালু প্রতি ঘনফুট ২০ টাকা দরে বিক্রি করে প্রশাসন। এই হিসাবে পাউবোর ১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৮৯০ ঘনফুট বালুর দাম দাঁড়ায় ২৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। এত টাকার বালু গায়ের জোরে মাত্র ৩৯ লাখ টাকায় (প্রতি ঘনফুট ৩০ পয়সা দরে) কিনে নেয় এরশাদ-ফয়সাল-সালাউদ্দিন চক্র। এমন বালু দুর্নীতির তথ্য জেনেও বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান তা না ঠেকিয়ে নিরাপদে বালু ব্যবসা চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন।
কর্ণফুলী নদীর বালুর মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন এরশাদ মাহমুদ ও ফয়সাল চৌধুরী। তাদের এ সিন্ডিকেটে আছে সালাউদ্দিন চৌধুরী, মঞ্জুর আলম ও মো. মুরাদ। অনিয়মের মাধ্যমে বরাদ্দ ভাগিয়ে নেওয়া ফয়সাল চৌধুরী কাগজ-কলমে সালাউদ্দিন চৌধুরী শান এন্টারপ্রাইজের কাছে বিক্রি দেখিয়ে হাতবদল করেন। কারণ এরশাদ-ফয়সাল আত্মগোপনে থাকায় তারা রাঙ্গুনিয়ায় গিয়ে বালু ব্যবসা দেখাশোনা করতে পারছেন না। তাই তাদের সিন্ডিকেটের সদস্য সালাউদ্দিনকে সামনে রেখে ব্যবসা সচল রাখেন। সালাউদ্দিন এ বালু প্রতি ঘনফুট ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে রাঙ্গুনিয়া ও চট্টগ্রাম শহরে বিক্রি করছেন।
রাজস্ব এখন ১০ গুণ
হাছান পরিবারের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রাঙ্গুনিয়ার আটটি বালুমহালের ইজারা এক লাফে হয়েছে ১০ গুণ। গত বছর আটটি মহাল থেকে ১ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছিল সরকার। এ বছর তা এক লাফে ১০ কোটি টাকা বেড়ে যায়। সাড়ে ১৫ বছর এরশাদের রাজত্বে কেউ বালুমহালের ইজারা নিতে সাহসই পেতেন না। তাই আটটি মহাল নামে-বেনামে নামমাত্র দামে ইজারা নিত চক্রটি। এবার জিম্মি দশামুক্ত হওয়ায় গত ২০ মার্চ আটটি বালুমহালে একাধিক ব্যবসায়ী ডাকে অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতা করেন।
ডাকে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী নাজমুল হক বলেন, সাড়ে ১৫ বছর এরশাদ ছাড়া এখানে আর কেউ ইজারায় অংশ নেওয়ার সাহস দেখাত না। ৫ আগস্টের পর এ পরিবার পালিয়ে যাওয়ায় এখন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ইজারাদার মিলছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন, চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি আকতার কবির চৌধুরী বলেন, এটা ভয়াবহ রকমের দুর্নীতি। দুদকের উচিত জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা।
রাঙ্গুনিয়ার ইউএনও মাহমুদুল হাসান বলেন, প্রতি ঘনফুট বালু ৩০ পয়সায় বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।
বালু বরাদ্দ দেওয়া তৎকালীন ইউএনও রায়হান মেহেবুব বলেন, তখন বালু কত টাকায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা নথি না দেখে বলতে পারব না। তবে ইউএনও হিসেবে যা করেছি, আইন মেনেই করেছি।