ধুঁকছে পদ্মা, মরে গেছে অসংখ্য শাখা নদী

একসময়ের প্রমত্তা পদ্মা নদী এখন বিবর্ণ। উজানে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বিশাল অংশ বালুচরে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি আলুপট্টির পাশের চর থেকে তোলা- শরিফুল ইসলাম তোতা
সৌরভ হাবিব, রাজশাহী
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫ | ০১:২০ | আপডেট: ১৬ মে ২০২৫ | ০৭:২১
বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ধু-ধু বালুচর। সেই চর দখল করে অনেকেই গড়ে তুলেছেন রেস্তোরাঁ, পিকনিক স্পট, দালান। ফেলা হচ্ছে রাজশাহী নগরীর বর্জ্যও। এরই মাঝে সংকীর্ণ ধারায় বইছে পানি। এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার চিত্র এটি।
ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করার পর থেকেই ধুঁকছে পদ্মা। এ বাঁধের প্রভাবেই নদীর বুকে জেগেছে বিশাল চর। মরে গেছে অসংখ্য শাখা নদী। হারিয়ে গেছে নানা প্রজাতির মাছ। জেলেরা হারিয়েছেন তাদের পেশা। শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার চললেও বর্ষাকালে হঠাৎ বাঁধের সব গেট খুলে দেওয়া হয়। এতে প্রায় প্রতিবছর দেখা দিচ্ছে ভয়ারহ বন্যা ও ভাঙন।
১৯৭৫ সালে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করে ভারত। সেখানে খাল খনন করে ভাগীরথী নদীতে পানি সরিয়ে নিচ্ছে তারা। এতে সচল থাকছে কলকাতা বন্দর। শুষ্ক মৌসুমে এই পয়েন্টে পানি সরিয়ে নেওয়ায় পদ্মায় তৈরি হচ্ছে মারাত্মক সংকট। এদিকে গঙ্গা পানিচুক্তির ৩০ বছর মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ বছরের ডিসেম্বরে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। এই বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা অভিমুখে লাখো মানুষের লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। লংমার্চ শেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট হাই স্কুল মাঠে বিশাল সমাবেশে বক্তব্য দেন মওলানা ভাসানী। এই লংমার্চ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
গবেষকরা বলছেন, এভাবে বাঁধ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন অনেকেই।
ভারত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মনাকষা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পদ্মা। রাজশাহী অঞ্চলে পদ্মা নাম প্রচলিত হলেও ভারতের উৎপত্তিস্থল থেকে গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারি কাগজপত্রে গঙ্গা নদী। গোয়ালন্দঘাট থেকে পদ্মা নাম ধারণ করে আরও ১২০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরে মেঘনায় মিলিত হয়ে সমুদ্রে মিশেছে।
বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের সাতজন গবেষক রাজশাহীতে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন। এটি নিয়ে প্রতিবেদন স্প্রিঙ্গার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, ১৯৭৪ সালে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানিপ্রবাহ ছিল ৩ হাজার ৬৮৫ ঘনমিটার। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ উদ্বোধনের পর শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ কমে ১ হাজার ৭৬ ঘনমিটারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ পানির প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে ৭১ শতাংশ।
গঙ্গা পানিচুক্তি নবায়ন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে চলমান বৈরিতায় পানিচুক্তি নবায়ন নিয়ে আশঙ্কা আছে। আশা করি শিগগির বৈরিতা শেষ হবে। আমরা এবার শুধু কাগুজের ৩৫ হাজার কিউসেক পানিতে সন্তুষ্ট থাকতে চাই না। চুক্তি নবায়ন হলে পানি চাইতে হবে। সারাবছর যেন নদীতে পানির প্রবাহ থাকে। একই সঙ্গে একটি পরিষ্কার তথ্য থাকতে হবে, ভারত ফারাক্কার পয়েন্টে কত কিউসেক পানি দিচ্ছে এবং আমরা কত কিউসেক পাচ্ছি।’
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ভারতের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কথাবার্তায় বৈরিতার বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায়। এতে নতুন করে চুক্তি নিয়ে আশঙ্কা আছে। কোনো কারণে যদি চুক্তি না হয়, তবে চীনের সঙ্গে কাজ করতে হবে। চীন এবং নেপাল অনেক নদীর উৎপত্তিস্থল। চীনের সঙ্গে যখন বাংলাদেশ চলবে, তখন ভারতই নমনীয় হবে। তারা সুসম্পর্ক রেখে চুক্তি করতে চাইবে।
ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মার অধিকাংশ শাখা নদী পুরোপুরি মরে গেছে। রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মার শাখা বড়াল নদী এখন পুরোপুরি মৃত। নদীর দু’পাশ বেদখল হয়ে গেছে। এসব এখন ফসলি জমি। মাঝে একটি চিকন নালা নদীর স্মৃতিচিহ্ন রেখেছে। বড়ালের শাখা মুসাখাঁ নদীও মরে গেছে।
নদী গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘বাংলাদেশের দুই হাজার কিলোমিটার নদীপথ ফারাক্কার প্রভাবে একেবারেই শেষ হয়ে গেছে। নদীপথে কম খরচে পণ্য পরিবহন করা যেত। এটা এখন আর হয় না। স্রোত না থাকায় ইলিশের ঝাঁক গোয়ালন্দের পর আর উজানে আসে না। আগে রাজশাহী শহরের পাশেও ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ত।’
তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার গঙ্গা। এই এলাকায় মহানন্দা, পাগলা, পুনর্ভবা, বড়াল, গড়াই, নারদ, হোজা, ভৈরব, বারনই, মুছাখাঁ, ইছামতী, কালীগঙ্গা, ধলাই, হুরাসাগর, চিকনাই, মাথাভাঙ্গা, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালীকুমার, হরিহর, কাজল, হিসনা, সাগরখালী, চন্দনা, বেলাবতসহ পদ্মার শতাধিক শাখানদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। উৎসমুখে পানি না পেয়ে ২৫টি নদী একেবারেই শেষ হয়ে গেছে। কৃষক নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করতে পারছেন না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এবিএম মোহসিন বলেন, মাছের আবাস ও প্রজননস্থল আগে পদ্মা নদীজুড়ে ছিল। কিন্তু ফারাক্কার প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এ ক্ষেত্র ছোট হয়ে আসছে।
- বিষয় :
- পদ্মা নদী