ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

৩৫ ভাটায় পুড়ছে কাঠ বিপন্ন কৃষি ও জনস্বাস্থ্য

৩৫ ভাটায় পুড়ছে কাঠ বিপন্ন কৃষি ও জনস্বাস্থ্য

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পুখুরিয়া গ্রামের স্টার ইটভাটায় করাতকল বসিয়ে কাঠ চেরাই করা হচ্ছে। এ কাঠ দিয়েই পোড়ানো হয় ইট সমকাল

মনোজ সাহা, গোপালগঞ্জ

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫ | ২৩:১৫

৩৯ ইটভাটার মধ্যে ৩৫টিতে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। অধিকাংশ ভাটায় করাতকল বসিয়ে কাঠ চেরাই চলছে। এসব কাঠ দিয়ে পোড়ানো হয় ইট। এতে গাছ উজাড় হয়ে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশ ও কৃষির। মানুষের শরীরেও বাসা বাঁধছে রোগ।
এমন চিত্র গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাইককান্দি সুকতাইল, জালালাবাদ ও চন্দ্রদীঘলিয়া ইউনিয়নের।
সম্প্রতি পাইককান্দি ইউনিয়নের পুখুরিয়া গ্রামের স্টার ইটভাটায় গিয়ে দেখা গেছে, ভাটার এক কোনে অবৈধভাবে স্থাপন করা হয়েছে করাতকল। সেখানে শ্রমিকরা কাঠ চেরাইয়ে ব্যস্ত। সেই কাঠ করাতকল থেকে ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাটার ক্লিমে (যেখানে ইট পোড়ানো হয়)। শ্রমিকরা পোড়ানোর জন্য কাঁচা ইট ভাটার ক্লিমে সাজাচ্ছেন। ইটের ফাঁকে ফাঁকে সাজিয়ে দিচ্ছেন কাঠ। অবৈধ ড্রাম চিমনি দিয়ে এখানে ইট পোড়ানো হচ্ছে। চিমনি দিয়ে অনর্গল কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। গোপালগঞ্জ জেলার মধ্যে এ গ্রামে ইটভাটার সংখ্যা সবেচেয়ে বেশি। এখানে অন্তত ২৬টি ইটভাটা রয়েছে। একটি ভাটার পাশে আরেকটি ভাটা। তাই গ্রামটি ইটভাটার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ইটভাটায় এ গ্রামের কৃষি, পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে অনেকের শরীরে। 
পুখুরিয়া গ্রামের এসবিআই ইটভাটার মালিক সিরাজ মোল্লার সঙ্গে কথা হয় তাঁর ইটভাটা কার্যালয়ে। তিনি বলেন, সদর উপজেলার পশ্চিম গোপালগঞ্জের পাইককান্দি, সুকতাইল, 
জালালাবাদ ও চন্দ্রদীঘলিয়া ইউনিয়নে মোট ৩৯টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টিতে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। মাত্র চারটি ভাটায় পোড়ানো হয় কয়লা। ৩৯টি মধ্যে ৩৮টি ভাটাতে পরিবেশবান্ধব জিগ-জ্যাগ চিমনি ব্যবহার করা হয়। একটি ভাটায় ড্রাম চিমনি রয়েছে। 
ভাটামালিক সিরাজ আরও বলেন, তারা ১৮ হাজার ২শ থেকে ১৮ হাজার ৭শ টাকা দরে প্রতিমণ কয়লা কিনে ইট পোড়াচ্ছেন। ৮ হাজার ৫শ টাকা দরে প্রতি হাজার ইট বিক্রি করছেন। যারা কাঠ দিয়ে ইট পোড়াচ্ছেন, তাদের খরচ অনেক কম হচ্ছে। তারাও একই দামে ইট বিক্রি করছেন। এতে তারা (সিরাজ) প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। তাই ভাটায় কাঠের ব্যবহার বন্ধের দাবি জানান তিনি। 
স্টার ইটভাটার কর্মী রিজু মোল্লা বলেন, শুধু তাদের ভাটায় নয়, এলাকার অধিকাংশ ভাটায় করাতকল রয়েছে। এসব করাতকলে কাঠ আনা হয়। সেই কাঠ চেরাই করে ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে। ভাটার শেষ মৌসুমে এখন দেদার কাঠ পুড়ছে বলে জানান তিনি।
একই ভাটার শ্রমিক মো. রাজু বলেন, তারা ভাটার ক্লিমে কাঁচা ইট সাজান। ইটের ফাঁকে ফাঁকে কাঠ সাজিয়ে দেন। এই কাঠ দিয়ে ভাটায় আগুন দেওয়া হয়। এ ভাটায় ড্রাম চিমনি দিয়ে ইট পোড়ানো হয় বলে তিনি জানান। তবে এটি বৈধ না অবৈধ তা তিনি জানেন না বলে মন্তব্য করেন।
স্টার ইটভাটার শ্রমিক মো. হাসান বলেন, এখানে কাজ করে হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও 
বুকের বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। এরপরও বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে সংসার চালাতে এখানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন।
পুখুরিয়া গ্রামের কৃষক জমির আলী শেখ বলেন, জেলার মধ্যে তাদের গ্রামে ইটভাটা সবচেয়ে বেশি। এখানে অন্তত ২৬টি ইটভাটা রয়েছে। স্টার ভাটা বাদে সব ভাটা পরিবেশেবান্ধব। কিন্তু অধিকাংশ ভাটায় কাঠ পোড়ানো হয়। এতে একদিকে যেমন গাছ উজাড় হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তাদের ফসলের ওপরও এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ছে। তাই তিনি ইটভাটায় অবাধে কাঠ পোড়ানো বন্ধের দাবি জানান।
গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন আবু সাইদ মো. ফারুক বলেন, ইটভাটায় কাঠ পুড়লে দেশের বনজ সম্পদ উজাড় হয়। ফলে বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের শরীরে অ্যালার্জি, বক্ষব্যাধিসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। তাই ইটভাটায় কয়লা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিবেশ রক্ষায় তারা তিন দফায় অবৈধ ১১টি ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করেছেন। ছয়টি ইটভাটা উচ্ছেদ করেছেন। ভাটাগুলো থেকে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। একভাটা মালিককে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধে তাদের অভিযান চলছে। পরিবেশ, মানুষের স্বাস্থ্য ও কৃষির ক্ষতিসাধন করে এমন ইটভাটা চলতে দেওয়া হবে না। পর্যায়ক্রমে এসব ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা। 

আরও পড়ুন

×