ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

চাষির চোখের নোনাজল ঝরিয়ে লবণের দাম বৃদ্ধি

চাষির চোখের নোনাজল ঝরিয়ে লবণের দাম বৃদ্ধি

কোলাজ

 তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম; মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, চকরিয়া

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৫ | ০১:১৫ | আপডেট: ২০ মে ২০২৫ | ০৮:৩৩

নভেম্বর থেকে এপ্রিল– এই ছয় মাসকে লবণ উৎপাদনের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। ডিসেম্বরে শুরু হয় পুরোদমে উৎপাদিত লবণ আহরণের কাজ। পরিবেশ অনুকূলে থাকায় আশানুরূপ উৎপাদন যেমন হয়েছে, তেমনি হাসি ফুটেছিল চাষির মুখে। উত্তোলিত লবণ বিক্রি করতে গিয়ে তাদের সেই হাসি শুধু ম্লানই হয়নি, চোখের কোণে দেখা দেয় নোনাজল। তবে চলতি মাসের শুরু থেকে লবণের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে গড়ে ১৫০ টাকা খরচ হয়। মিল মালিক ও ফড়িয়া সিন্ডিকেট এ পরিমাণ লবণের দাম ১২০-১৩০ টাকার বেশি দিতে রাজি হয়নি। ফলে লাভ তো দূরের কথা চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। ফলে অনেকে রাগে-ক্ষোভে আগামী মৌসুম থেকে লবণ চাষ না করার সিদ্ধান্ত নেন। অনেকে মাটির গর্ত খনন করে সেখানে পলিথিন বিছিয়ে লবণ জমিয়ে রাখেন। এক পর্যায়ে লবণ চাষ না করার বিষয়টি মিল মালিকদের প্রতিনিধি, মধ্যস্বত্বভোগী ও বিসিক কর্মকর্তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। এটিই টনিক হিসেবে কাজ দেয়। শেষ পর্যন্ত লবণ সংগ্রহে দাম বাড়াতে বাধ্য হন ক্রেতারা। চলতি মাসের শুরু থেকে প্রতি মণ লবণ বেচাকেনা হচ্ছে ৪০০ টাকা। গত মৌসুমেও এমন দামে লবণ বেচাকেনা হয়েছিল। এর আগে অন্তত সাড়ে ১১ লাখ টন লবণ বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা মণ দরে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্যমতে, দেশে বছরে লবণের চাহিদা কমবেশি ২৫ লাখ টন। এবারের মৌসুমে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৬ লাখ ১০ হাজার টন। গত ১৮ মে পর্যন্ত ২২ লাখ ৯১ হাজার ৬৫১ টন লবণ আহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উৎপাদিত লবণের প্রায় ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ অর্ধেক লবণ বেচাকেনা হয়েছে। এ হিসাবে বিক্রীত লবণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টন। সামনে কোরবানির ঈদ। এ সময় পশুর চামড়া সংরক্ষণে বিপুল পরিমাণ লবণের প্রয়োজন হয়। ফলে কয়েক দিনের মধ্যে লবণ বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যাবে বলে আশা করছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।

কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম হচ্ছে দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদন জোন। এই দুই অঞ্চলে মাঠ পর্যায়ে লবণ সংগ্রহ করে বিভিন্ন মিল-কারখানা মালিকের কাছে বিক্রি করে থাকেন কিছু মধ্যস্বত্বভোগী। মিল মালিকদের নির্দিষ্ট লোকজনও বিভিন্ন এলাকা থেকে লবণ সংগ্রহ করে থাকেন। মূলত এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই সিন্ডিকেট করে লবণের দাম বাড়ায়-কমায়। আবার তাদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে লবণ বাজারজাতকারী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বড় মাপের মিল মালিকরা। দুই পক্ষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কত পড়বে। তাদের কবলে পড়ে ক্ষতির শিকার হন চাষিরা। 

কক্সবাজারের চকরিয়ার ডেবডেবিয়া এলাকার লবণচাষি একরাম হোসেন সমকালকে বলেন– জমি বর্গা, পানির স্কিম, পলিথিন, শ্রমিকের মজুরি, আনুষঙ্গিক খরচসহ চাষিদের প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে গড়ে খরচ হয় ১৫০ টাকার ওপরে। এবারও এই ধরনের খরচ হয়েছে। কিন্তু শুরুর দিকে লবণ আহরণ করে যখন বিক্রি করতে যাই, তখন কোনোভাবে ১৪০ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারিনি। দেনা মেটাতে উৎপাদিত লবণের একটি অংশ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। ঝুঁকি নিয়ে অবশিষ্ট লবণ রেখে এখন প্রতি মণ ৪০০ টাকা  বিক্রি করছি।

বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লবণের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। প্রান্তিক পর্যায়ের চাষিদের কাছ থেকে এই লবণ সংগ্রহ করা হচ্ছে প্রতি কেজি মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকা দরে। এই চিত্র থেকে চাষিরা কীভাবে ঠকছেন তা অনুমান করা যায়। 

কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও ও টেকনাফ উপজেলা এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার অন্তত ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন করা হয়ে থাকে। বাঁশখালী উপজেলার খানখানাবাদ, বাহারছড়া, শেখেরখীল, কাথরিয়া, সরল, গন্ডামারা, চাম্বল, পুঁইছড়ি এবং ছনুয়া উপকূলীয় এলাকায় লবণ চাষ হয়। এসব এলাকায় গত বছর প্রায় ৮০ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়। এবার তার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হতে পারে ধারণা করছেন চাষি ও বিসিকের কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে চাষির সংখ্যা কমবেশি ৬৫ হাজার। দেশে চাহিদার অর্ধেক লবণ গৃহস্থালি ও খাবার তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। অবশিষ্ট লবণ চামড়া প্রক্রিয়াকরণ, টেক্সটাইল, কাগজ, সাবান, ডিটারজেন্ট ও রাসায়নিক দ্রব্য তৈরির কাজে লাগে।

লবণচাষিরা জানিয়েছেন, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কিছু মিল মালিক সিন্ডিকেট করে উৎপাদিত লবণের দাম কমিয়ে দেন। ওজনেও কারচুপি করেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। ৪০ কেজিতে এক মণ হলেও তারা মণ হিসাব করে ৪৫ কেজিতে। যে কারণে দুই মণ ওজনের এক বস্তা লবণ বিক্রি হচ্ছে ৫৬০ টাকা। এতে লবণচাষিরা লাভের মুখ দেখছেন না।

চকরিয়ার রামপুর এলাকার বাসিন্দা লবণচাষি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এবার আমি আড়াই কানি (১০০ শতক) জমিতে লবণ চাষ করেছি। এই পরিমাণ জমিতে কমবেশি ৫০০ মণ লবণ উৎপাদন হয়। শুরুর দিকে অর্ধেক লবণ বিক্রি করেছি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা মণ দরে। এতে এই লবণ উৎপাদনে যে খরচ হয়েছে তার অর্ধেকও উঠে আসেনি। এখন প্রতি মণ ৪০০ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে। ফলে খুব একটা লাভ না হলেও লোকসান কাটিয়ে ওঠা যাবে।’

কক্সবাজারভিত্তিক লবণ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শহীদ উল্লাহ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধভাবে দাম নির্ধারণ করে দিয়ে খুব কম দামে লবণ সংগ্রহ করেছেন। আবার মধ্যস্বত্বভোগীরাও সুবিধা নিয়েছেন। ফলে এবার চাষিরা  ক্ষতিগ্রস্ত।’

তবে চকরিয়ার বদরখালী এলাকার মধ্যস্বত্বভোগী (ফড়িয়া) মো. নুরুন্নবী মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কমিয়ে দেওয়ার জন্য মিল মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, মিল মালিকদের লবণ সংগ্রহ করে দিয়ে আমরা কিছু কমিশন পেয়ে থাকি। এবার দাম কম থাকায় আশানুরূপ কমিশন পাইনি।

বিসিকের কক্সবাজার পরিদর্শক ইদ্রিস আলী বলেন, লবণ সংগ্রহে জড়িতদের একটি সিন্ডিকেটের কারণে এতদিন লবণের ন্যায্য দাম পাননি চাষিরা। লবণের নায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বিসিকের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

আরও পড়ুন

×