ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

‘সময়মতো ঘুম না ভাঙলেই চিরঘুমে যেতে হতো’

‘সময়মতো ঘুম না ভাঙলেই চিরঘুমে যেতে হতো’

মঙ্গলবার ভোরে হানা দেয় বন্যহাতির পাল। সকালে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সামনে জড় হয় আতঙ্কিত এলাকাবাসী। নালিতাবাড়ীর বুরুঙ্গা কালাপানি এলাকা সমকাল

নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫ | ০০:৫০ | আপডেট: ২৮ মে ২০২৫ | ১১:৩৮

ঘড়িতে সময় ভোর পৌনে ৬টা। তখনও কিছু মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শাহীন মিস্ত্রি প্রতিদিনের মতোই তাঁর স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে ছোট একটি দোচালা টিনের ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ঘরের বেড়া ভাঙার শব্দে ঘুম ভাঙে শাহীনের স্ত্রীর। হঠাৎ মনে হলো কে যেন ঘরের টিনের বেড়ায় আঘাত করছে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্ত্রীর ডাকে একলাফে উঠে জানালার ফাঁক গলে দেখতে পান দুটি বন্যহাতি ঘরের বেড়াতে শুঁড় দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করছে।

হাতি দুটির পেছনে আরও কমপক্ষে ৩৫-৪০টি ঘোরাঘুরি করছে। বন্যহাতির পালের আক্রমণ দেখে চিৎকার করতে থাকেন শাহীন। এক পর্যায়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ততক্ষণে হাতির পাল ঘরের বেড়া ভেঙে বস্তার ধান খেয়ে আসবাব শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ও পায়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে ফেলে।

গতকাল মঙ্গলবার ভোরে নালিতাবাড়ী উপজেলার বুরুঙ্গা কালাপানি এলাকায় হাতির পাল এ তাণ্ডব চালায়। এর আগের দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাতকুচি বন বিভাগের বিট কার্যালয়ে হাতির পাল আক্রমণ করে ঘরের আসবাব তছনছ করে ফেলে।

জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে বিট কার্যালয়ের সীমানায় ৪০-৪৫টি বন্যহাতির আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। খবর পেয়ে বন বিভাগের লোকজন, গ্রামবাসী ও এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্যরা তাড়িয়ে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেন। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাতির পালটি বাতকুচি বিট কার্যালয়ের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। রাত বাড়লে ৪-৫টি হাতি বিট অফিসের ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে ফেলে। এ সময় দলের সঙ্গে থাকা কয়েকটি হাতির শাবক ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। পরে ঘরে থাকা চাল খেয়ে ফেলে এবং তিনটি কক্ষে থাকা সব আসবাব ভেঙে তছনছ করে। পরে স্থানীয়দের ধাওয়া খেয়ে সেখান থেকে হাতির পালটি প্রস্তাবিত দাওধারা কাটাবাড়ি পর্যটন কেন্দ্রে অবস্থান করে ও জঙ্গলের দিকে চলে যায়। এর পর ভোর রাতে হানা দেয় বুরুঙ্গা কালাপানি এলাকায়। এ সময় সুফিয়া বেগম, সাফিকুল ইসলাম, হাসনা ভানু, শহর ভানু ও মাজেদা খাতুনের বসবাসের ঘরটি গুঁড়িয়ে দেয় হাতির পাল। ঘরে থাকা তাদের ১৬০ মণ ধান ও ৩০ মণ চাল খেয়ে সাবাড় করে হাতির পাল। খবর পেয়ে ইআরটি সদস্য ও গ্রামবাসী মিলে হুইহুল্লোড় করে হাতির পালকে বন ফেরাতে সক্ষম হয়।

ক্ষতিগ্রস্ত সুফিয়া বেগম জানান, হঠাৎ করে হাতির পাল বাড়িঘরে হামলা করেছে। থাকার একমাত্র ঘরটি হাতি ভেঙে দিয়েছে। সকালে বন বিভাগের লোকজন এসে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। এখনও হাতির আতঙ্ক রয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত মাজেদা খাতুনের ভাষ্য, যদি সময়মতো ঘুম না ভাঙত তাহলে হয়তো হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মরতে হতো। এখনও হাতির ভয় কাটছে না। ভুক্তভোগী শাহীন বলেন, সময়মতো ঘুম না ভাঙলে আজই (মঙ্গলবার) হয়তো চিরঘুমে চলে যেতে হতো আমাদের।

এলাকাবাসী আশঙ্কা করছেন, ফের বন্যহাতি যে কোনো সময় হানা দিতে পারে। তারা জানান, প্রায় দুই যুগ ধরে বন্যহাতির সঙ্গে লড়াই করে কোনো রকমে টিকে আছেন তারা। প্রতিনিয়ত বন্যহাতির পাল আক্রমণ করে তাদের জানমালের ক্ষতি করছে। নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

শমশ্চুড়া বিট কর্মকর্তা কাওসার হোসেন বলেন, শমশ্চুড়া ও কাটাবাড়ি এলাকার জঙ্গলে ৩০-৩৫টি হাতি দুই ভাগে অবস্থান করছে। বিট কার্যালয় ভেঙে শেষ রাতে কয়েকটি ঘর ভেঙে ফেলেছে।

এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা শাহীন কবিরের ভাষ্য, বিট কার্যালয় ভাঙচুরের পর রাতে কয়েকটি বসতঘরেও হামলা চালিয়েছে হাতির পাল। মঙ্গলবার ভোরে প্রায় ৪১ সদস্যের বন্যহাতির পাল ৬-৭টি বসতঘরের ভাঙচুর চালিয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

×