ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

জব্দ বালু প্রকাশ্যে লুট পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

জব্দ বালু প্রকাশ্যে লুট পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

সিরাজগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে ধামালিয়া নদীতে রাখা প্রশাসনের জব্দকৃত বালুর স্তূপ সমকাল

 সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫ | ২৩:৪২

অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালু জব্দের পর প্রশাসনের হেফাজতে থাকা সেই বালুও প্রকাশ্যে লুট করা হচ্ছে। সেটি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট তৎপরতা নেই দায়িত্বশীলদের। জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার এ ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, প্রশাসনের চোখের সামনে জব্দ করা বালু লুটে নিচ্ছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি চক্র।
অভিযোগ রয়েছে এই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা বিএনপির এক নেতা। পরে খোঁজ নিতে গিয়ে দলটির অপর এক নেতার বরাতে তথ্য মেলে, চক্রের নেতৃত্বে থাকা সেই ব্যক্তি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রাজু আহমেদ। তাঁর বলয়ের প্রভাব খাটিয়েই চক্রটি সরকারি বালু লুটে নিচ্ছে কোনো বিধিনিষেধ গ্রাহ্য না করে।
এদিকে এমন অভিযোগের কথা অস্বীকার করে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রাজু আহমেদ বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য নয়। বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলের ভেতরের বা বাইরের কেউ অবৈধ কিছু করতে গেলে বাধা দিচ্ছি। সেজন্যই উল্টো আমাকে বিতর্কিত করতে মিথ্যাচার করা হচ্ছে।’ 
অভিযোগকারীরা জব্দের বালু উত্তোলনে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়কের ঘনিষ্ঠ উপজেলা যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক সৈয়দ রমিজ উদ্দিন ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামও জানান। সৈয়দ রমিজ উদ্দিন বলেন, জব্দের বালু ওখানে আছে বলেই জানি না আমি। আমার আত্মীয়স্বজন কেউ এই কাজেও জড়িত নয়।
সূত্রের তথ্যমতে, প্রশাসনের হেফাজতে থাকা ১ লাখ ৮০ হাজার ঘনফুট বালুর বাজার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। এ ছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। তথ্য অনুসারে সুনামগঞ্জ জেলাধীন এই উপজেলা পরিদর্শনে গিয়ে পাহাড়ি নদী ধামালিয়ার তীর থেকে অনুমোদনহীন বেপরোয়া বালু উত্তোলনের দৃশ্য নজরে পড়ে।
উপজেলার এই নদীটির বড় একটি অংশ ভরাট হয়ে গেছে আগেই। সেই অংশটি পরিণত হয়েছে বালুর খনিতে। নদীর কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভরাট ওই অংশে কয়েক কোটি টাকার বালুর মজুত রয়েছে বলে ধারণা স্থানীয় বাসিন্দাদের।
এ ছাড়া নদীর যে অংশটুকু এখনও অস্তিত্ব ধরে রেখেছে শুষ্ক মৌসুমে সেটিও শুকিয়ে যায়। তলদেশ শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে বালুর স্তূপ জমে। নদী-তীরবর্তী জলিলপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা অবৈধভাবে সেই বালু উত্তোলন করে স্তূপ করে রেখেছেন। প্রতিটি স্তূপে রয়েছে কয়েক লাখ ঘনফুট বালুর মজুত।
দুই মাস আগে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে এসব বালু জব্দ করে। সরকারি হিসাবে জব্দকৃত এই বালুর পরিমাণ এক লাখ ৮০ হাজার ঘনফুট। টাকার অঙ্কে এই বালুর দাম দেড় কোটি টাকারও বেশি বলে জানানো হয়। তবে জব্দকৃত বালু নিলামের কোনো উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন।
সম্প্রতি নদীতে পানি এলে স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় বালুখেকো চক্রের সদস্যরা বাল্কহেড, ট্রলার, ট্রাক ভরাট করে এসব বালু নিতে শুরু করে। এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, গ্রামের লোকজন বালু বহনকারী নৌকা-বাল্কহেড আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করলেও তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে উপজেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ প্রসঙ্গে সরব হন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছবাব মিয়া। তিনি বালু বিক্রিতে নিলামের ব্যবস্থা না করায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
বুধবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা জানা যায়, ২২ জুন চারটি বাল্কহেডে করে জব্দের বালু নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়রা বালুখেকোদের আটক করতে পুলিশে খবর দেন। পরে বিশ্বম্ভরপুর থানার এসআই মুজিবুর রহমান ঘটনাস্থলে এসে এই বাল্কহেডগুলো জব্দ করেন। পরে বসন্তপুর গ্রামের বকুল মিয়ার হেফাজতে দেওয়া হয় সেগুলো। জিম্মাদার হিসেবে বকুলের স্বাক্ষরও নেয় পুলিশ। এর কিছুক্ষণ পরেই চক্রের লোকজন এসে বালুসহ বাল্কহেড নিয়ে যায়। 
এ ঘটনায় বকুল মিয়া জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, তাঁকে আটককরা বালুসহ বাল্কহেডের জিম্মাদার করে পুলিশ। এরপর পুলিশের সামনে দিয়েই সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয়। বকুল মিয়া বলেন, ভরাট হওয়া ধামালিয়ার পারের জলিলপুর গ্রামের প্রতিটি বাড়ির পেছনে বালু স্তূপ করে রাখা আছে। এসব বালু উপজেলা প্রশাসন জব্দও করেছে। একটি চক্র এই বালু নদীপথে নিয়ে যাচ্ছে। 
হালাবাদি গ্রামের বাসিন্দা আল-আমিনসহ অন্যদের প্রশ্ন, প্রশাসনের হেফাজতে থাকা বালু কীভাবে লুট হয়? এটি বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না তাদের। উল্টো সিন্ডিকেটের হুমকি-ধমকি সহ্য করতে হচ্ছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম খন্দকার বলেন, জব্দকৃত বালু লুটপাটের প্রতিবাদ করায় তাঁকে হুমকি দিয়েছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রাজু আহমেদ। কয়েকদিন আগে বালুবোঝাই কয়েকটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আটকিয়ে পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন তিনি। পরে জানতে পারেন সেগুলো উপজেলা বিএনপি নেতা রাজু আহমেদের।
এর জবাবে রাজু আহমেদ বলেন, বালু লুটপাটসহ সব অবৈধ কাজ বন্ধে তিনি প্রশাসনকে সহযোগিতা করেন। এখানে রাজনীতির কাটাকাটি চলছে। নদী থেকে যারা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেছে, তারা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারাই বিএনপির সুবিধাভোগীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে বালু লুট করছে।
বিএনপির আহ্বায়ক রাজু আহমেদ বলেন, বিশ্বম্ভরপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ জব্দের বালু ছাড়াতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন। সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ জানান, জব্দের বালু লুট নয়, নিলাম দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
বিশ্বম্ভরপুর থানার এসআই মজিবুর রহমান বলেন, ২২ জুন রাতে অন্য ডিউটিতে ছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জানতে পারেন বসন্তপুর এলাকায় কিছু লোক বালুভর্তি নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন। পরে ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। সেগুলো আটক করে বকুল মিয়ার জিম্মায় দিয়ে চলে আসেন। পরে জানতে পারেন নৌকাগুলো চলে গেছে।
বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ছবাব মিয়া বলেন, এক লাখ ৮০ হাজার ঘনফুট বালুর দাম কমপেক্ষ দেড় কোটি টাকা। সরকারি এই বালু লুটপাট যাতে না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা সভায় কথা বলেছেন। ইউএনও মফিজুর রহমান বলেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। জানতে পেরেছেন জব্দ করা বালু কারা নিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে।
 

আরও পড়ুন

×