চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস কর্মকর্তা জসিমের আলিশান বাড়ি

চট্টগ্রামের লালখানবাজারে জসিম উদ্দিন চৌধুরীর পাঁচতলা বাড়ি- সমকাল
আহমেদ কুতুব, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:০৪ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:৪৪
চট্টগ্রামে শহরের প্রাণকেন্দ্র লালখান বাজারে পাঁচতলা বাড়ি করেছেন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন চৌধুরী। গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীতে রয়েছে বিপুল জমিজমা। চাকরিতে প্রবেশের পর গ্রাম ও শহরে দ্রুত বেড়েছে নিজের ও স্ত্রী সানজিদা বেগমের সম্পদ। ২০০৭ সালেই কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব জমা দেন দুদকে। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে ২০১১ সালে জ্ঞাত আয়- বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। অর্ধকোটি টাকার হিসাব বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে চলতি বছরের ২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে স্বামী-স্ত্রীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে প্রতিষ্ঠানটি। অভিযুক্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন চৌধুরী ও তার স্ত্রী ২০১১ সালে মামলা দায়েরের পর থেকে পলাতক।
মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা, দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম জানান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সহকারী কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন চৌধুরী দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
তার নিজের ও স্ত্রীর নামে শহর ও গ্রামে বহু সম্পদ রয়েছে। শহরের লালখান বাজারে তাদের একটি বহুতল বাড়ি থাকলেও যে দামে জায়গাটি কেনার দলিল তারা দুদকে জমা দিয়েছেন, তা অবিশ্বাস্য। তারা পলাতক থাকায় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
অভিযুক্ত জসিম উদ্দিন চৌধুরীকে মোবাইল ফোনে না পেয়ে তার লালখান বাজারের বাড়িতে দুই দফা গিয়ে সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি। বাড়ির কেয়ারটেকার গিয়াস উদ্দিন জানান, 'বাড়ির মালিক জসিম উদ্দিন চৌধুরী ও তার স্ত্রী ১০-১২ দিন ধরে বাসায় থাকছেন না। তারা কোথায় আছেন জানি না।'

সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জসিম উদ্দিন চৌধুরী সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর অবৈধ অর্থ-সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পায় দুদক। এর আলোকে ২০০৭ সাল থেকে তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধান শেষে অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়ায় জসিম ও তার স্ত্রীকে আসামি করে ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর ডবলমুরিং থানায় দুর্নীতি মামলা দায়ের করা হয়। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৪ জুলাই দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। দুদক প্রসিকিউশন টিম গত ২২ সেপ্টেম্বর ওই চার্জশিট চট্টগ্রাম সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে জমা দেয়। চার্জশিটে দুই আসামিকে পলাতক দেখানো হয়। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে গ্রেফতারি ও ক্রোকি পরোয়ানা ইস্যুর আবেদন করা হয়।
লালখান বাজারে পাঁচতলা বাড়ি :চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা লালখান বাজার। এখানকার চানমারী রোডের ৩৯২/বি পাঁচতলা বাড়ির মালিক গ্যাস কর্মকর্তা জসিম উদ্দিনের স্ত্রী সানজিদা বেগম। এ এলাকায় এখন আটশ' থেকে এক হাজার বর্গফুটের যে কোনো ফ্ল্যাট ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকায় সহজেই বেচাকেনা হয়। আর দুই গণ্ডা জমির দাম দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা। সেই হিসাবে বর্তমানে জমিসহ আলিশান পাঁচতলা বাড়িটির মূল্য আট থেকে দশ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। চানমারী এলাকার সিদ্দিক ভবনের মালিক মো. সিদ্দিক আহমেদ বলেন, চানমারী এলাকায় এখন এক গণ্ডা জমি এক থেকে দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর আটশ' থেকে এক হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে এখানে দুই লাখ টাকায় দুই গণ্ডা জমি কেনার কথা কেউ বললে তিনি অসত্য কথা বলছেন। ৫০ বছর আগেও দুই লাখ টাকায় দুই গণ্ডা জমি এখানে তো নয়ই, পাহাড়ের ওপরেও কিনতে পাওয়া যেত না। তথ্য গোপন করার জন্য দলিলে টাকা কম দেখাতেই এই কারসাজি হতে পারে বলে অভিমত ৬৫ বছর বয়সী সিদ্দিক আহমেদের।
দুদকের চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ দম্পতি বাড়ি নির্মাণ ব্যয় ১২ লাখ ৪০ হাজার ৬৯১ টাকা কম দেখিয়েছেন। এ ছাড়া তারা নিজের নামে চারটি দলিলের মাধ্যমে ক্রয় করা ১০৬ শতক জমির বিষয়টি উল্লেখই করেননি। ২০০৭ সালের আগে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সহায়তায় ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৬৯১ টাকা জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। চার্জশিটে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৭ সালের ২৩ মার্চ গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী কাজী সামসুদ্দিন, প্রকৌশলী আবু তাহের অভিযুক্ত আসামি জসিম উদ্দিন চৌধুরী ও সানজিদা বেগমের উপস্থিতিতে পাঁচতলা ভবনের পরিমাপ করা হয়। প্রকৌশলীদের প্রতিবেদনে বাড়িটির নির্মাণ ব্যয় তুলে ধরা হয় ৪৩ লাখ ৮ হাজার ৩৭৬ টাকা। ১৯৯৬ সালের ২৮ জুলাই কেনা দলিলে জমির মূল্য লেখা হয় এক লাখ ৯৪ হাজার ৭৮৫ টাকা। তবে অভিযুক্তরা দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাড়িটি নির্মাণ ও জমির ক্রয়মূল্য দেখান ৩২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৮৫ হাজার টাকা। তদন্ত শেষে দুদক জানায়, এখানেও এ দম্পতি ১২ লাখ ৪০ হাজার ৬৯১ টাকা সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করেছেন। তারা সর্বমোট ২৫ লাখ ৭১ হাজার ১২৬ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়- বহির্ভূত সম্পদ অসাধু উপায়ে অর্জন করেন।
বাঁশখালীতে কিছুদিন পরপরই কিনেছেন জমি :গ্যাস কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরুর পর এ দম্পতি গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীতে কিছুদিন পরপর কিনেছেন প্রচুর জমি। বাঁশখালীর ইলশায় তাদের নামে ১৯৯১ সালের ১০ জুন তিন গণ্ডা নাল জমি, বাঁশখালীতে ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৫ গণ্ডা কৃষিজমি, ১৯৯৫ সালের ১২ ডিসেম্বর ৪০ গণ্ডা কৃষিজমি, ৬ জুন ৪ গণ্ডা কৃষিজমি, ২৬ ফেব্রুয়ারি ৩ গণ্ডা কৃষিজমি, নগরীর লালখান বাজারে ১৯৯৬ সালের ২৮ জুলাই দুই গণ্ডা জায়গা, ওই বছর ৬ এপ্রিল বাঁশখালীতে আট গণ্ডা কৃষিজমি, ২০০৫ সালের ১৪ মে পাঁচ গণ্ডা জমি, ২০০৩ সালের ২০ অক্টোবর ৩৭ গণ্ডা কৃষিজমি, ২০০২ সালের ১২ নভেম্বর ১৫ গণ্ডা বাড়ির জমি, ভিটা ও পুকুর, ২০০৩ সালের ১৭ মে আড়াই গণ্ডা কৃষিজমি, ২০ অক্টোবর দেড় গণ্ডা কৃষি জমি, এর আগে বাঁশখালীতে তিনি ৫০ গণ্ডা কৃষিজমি, ৭৩ গণ্ডা কৃষি জমি ও আট কানি কৃষিজমি কিনেছেন। এ ছাড়া দুদক তদন্তে উঠে আসে- গ্যাস কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন চৌধুরী একজন সহকারী কর্মকর্তা হলেও ১৯৮৯ সালের ১৯ মার্চের আগে তার স্ত্রী সানজিদা বেগমের নামে ছিল ২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। আছে নামে-বেনামে বহু অবৈধ জমিজমাও।
অভিযুক্ত জসিম উদ্দিন চৌধুরী বাঁশখালীর ইলশার মৃত কবির উদ্দিন চৌধুরীর ছেলে। তিনি বর্তমানে কর্ণফুলী গ্যাস সিস্টেমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (শেয়ার, চলতি দায়িত্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।