ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

সমঅধিকারের প্রশ্নে

সমঅধিকারের প্রশ্নে

প্রতিকী ছবি

বনশ্রী মিত্র নিয়োগী

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪ | ২৩:১৮ | আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৪ | ১০:৩৭

রাষ্ট্রীয়, সমাজ ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে অনেক ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়নের তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রযাত্রা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সাম্প্রতিককালে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারীর বিরুদ্ধে বঞ্চনা ও অপরাধ রোধসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে দৃশ্যমান অনেক পরিকল্পনা-প্রকল্প-প্রচেষ্টা।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সমতা ও প্রগতির পথের যাত্রা খুব একটা সহজ কাজ না বা সমৃদ্ধি অর্জনের পথও সহজ নয়। নারী ও মেয়েদের উন্নয়নের জন্য অধিকতর বিনিয়োগ সমতা ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায় হতে পারে। সমাজের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে নারী ও মেয়েদের অবদান অমূল্য। কিন্তু নারীদের অধিকাংশই তাদের স্বপ্ন ও উচ্চ লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য যে সময় ও সুযোগ প্রয়োজন, তা থেকে বঞ্চিত হয়। সামগ্রিক বাস্তবতায় জীবন ও দেশের প্রেক্ষিতে সব দিকে নারী ও মেয়েদের অধিকার নিশ্চিত করাই হলো সমৃদ্ধ ও ন্যায়সংগত সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ পৃথিবীর নিরাপত্তার অন্যতম উপায়। জেন্ডার সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশ্ব একাধিক সংকটের মুখোমুখি– যা নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন, অগ্রযাত্রা ও সমতা অর্জনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে সমতা অর্জনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অর্থায়নের একটি পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাব। অথচ জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী এর জন্য বাজেট রয়েছে ৩৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

যথাযথ ও বাড়তি বিনিয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তনের সময় এখনই। তাই নারী ও মেয়েদের জন্য অধিক বিনিয়োগ এবং অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বানে এ বছর সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রত্যয়– ‘নারীর সমঅধিকার সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। এ প্রত্যয়ে দিবসটি পালনের নানা ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। 
নারী ও মেয়েশিশুদের জন্য বিনিয়োগ একটি মানবাধিকার ইস্যু। সময় খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতা প্রতিষ্ঠা মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং সব শ্রেণি-পেশার নারীর জন্য বিনিয়োগও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মনে রাখতে হবে, নারীর অগ্রগতি ও ক্ষমতায়ন সমাজ ও পরিবারকেই সবচেয়ে বেশি উপকৃত করে। এতে চূড়ান্তভাবে লাভবান হয় দেশ ও জাতি।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু বিপর্যয়, ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, কভিড মহামারি, অর্থনৈতিক অস্থিরতা অতিরিক্ত ৭৫ মিলিয়ন মানুষকে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে নিয়ে গেছে। এর ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৪২ মিলিয়নেরও বেশি নারী ও মেয়েশিশু দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। তাই জরুরি ভিত্তিতে এ খাতে অর্থ বরাদ্দ ও সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণের এটিই উপযুক্ত সময়।
ব্যাপক অর্থে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে হলে বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও প্রয়োজনীয় জেন্ডার গ্যাপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত দুটি বিষয় হলো, জাতীয় সংসদে নারীর প্রবেশযোগ্যতা ও নারী ইস্যুর প্রতি রাজনৈতিক দলের অবস্থান। নারীর ক্ষমতা ও সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ দুটি ক্ষেত্রে নারীর জোরালো উপস্থিতি প্রয়োজন। নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় জড়িয়ে আছে।

এ উপাদানগুলো নারীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা ধারণ করে রাজনৈতিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ক্ষেত্রগুলো। নারীর ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ও স্বয়ম্ভরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়োজন নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। কেননা নারীর প্রয়োজন ও পরিপ্রেক্ষিত যথাযথভাবে উপস্থাপন করার যোগ্যতা নারী তার জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে ধারণ করে থাকে। এখানেই নারীর ক্ষমতায়ন ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পারস্পরিক সম্পৃক্তি। কিন্তু এ দুটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি।

নারী ও মেয়েশিশুদের জন্য পরিকল্পিত বিনিয়োগ বাড়িয়ে জেন্ডার সমতা অর্জনের দীর্ঘ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে জেন্ডার বাজেট রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু জেন্ডার বাজেট মানে শুধুই নারী ও মেয়েশিশুদের জন্য বিনিয়োগ করা বোঝায় না। একটি সুস্থ ও উন্নত সমাজের জন্য জেন্ডার বাজেট ও নারীর জন্য বিনিয়োগ প্রযুক্তি ও সামাজিক পরিবর্তনে রাখতে পারে বিশেষ অবদান। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায়র ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দ কমেছে ১ শতাংশ। মোট ৪৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে জেন্ডার বাজেট ছিল ৩৪ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৯.৬ কোটি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৮.৬ কোটি টাকা। এবারের মোট জেন্ডার বাজেট ৪ কোটি ৫৪ লাখ ২১১.৩ কোটি টাকা। জনসংখ্যা অনুপাতে এই বরাদ্দ যে খুবই অপ্রতুল, তা বলা বাহুল্য। তবে এটিও ঠিক যে কত বরাদ্দের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নারী ও মেয়েশিশুদের জরুরি কল্যাণ সুবিধা ও অগ্রগতির জন্য বরাদ্দ কত বা অগ্রাধিকার কোথায় দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ৩৬.১৪ শতাংশ নারী, যারা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতে কাজ করে থাকে। এখনও নারীদের ৯১ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। ফলে সমমজুরি, সমসুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা সবকিছু থেকে তারা বঞ্চিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই অনানুষ্ঠানিক গৃহস্থালি বা সেবা কাজের খাতে নারীর শ্রম জিডিপিতে যুক্ত হয় না।

কন্যাশিশু ও নারীদের ক্ষমতায়ন শুধু যে সঠিক কাজ তা নয়, এটি টেকসই উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে কার্যকর বিনিয়োগ, যার প্রভাব নারীদের ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যখন অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কন্যাশিশু স্কুলে যায়, তখন একটি দেশের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যখন নারীরা তাদের কাজের ন্যায্য মজুরি পায়, তখন পরিবারের উন্নতি হয়। গবেষণায় দেখা যায়, নারীরা তাদের উপার্জনের একটি বড় অংশ সন্তানের স্বাস্থ্য, লেখাপড়া ও পরিবারের উন্নতির কাজে ব্যয় করে, যেখানে পরিবারের পুরুষেরা প্রায়ই অন্যান্য বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।  নতুন প্রজন্মের নারীসমাজ জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়াটাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। সুযোগ পেলে পুরুষদের সঙ্গে প্রতিটি ক্ষেত্রে সমানতালে এগিয়ে আসার প্রবণতাকে নাগরিক জীবন খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছে। হাটবাজার, জনসভা, মিটিং, মিছিল, খেলার মাঠ, শিক্ষায়তনের ক্যাম্পাস⎯ সর্বত্র নারীর স্বচ্ছন্দ চলাচল যেমন বেড়েছে, তেমনি বিশ্বায়নের জোয়ারে তার অর্জনের আকাঙ্ক্ষার সীমানাও হয়েছে দিগন্তপ্রসারী। 

লেখক: পরিচালক-কর্মসূচি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

আরও পড়ুন

×