ড. ইউনূসের ফেসবুক স্ট্যাটাস
‘সালমা খান, তোমাকে কীভাবে বিদায় জানাবো’

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২২ | ০৫:০২ | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২২ | ০৫:০৫
নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ সংক্রান্ত (সিডও) জাতিসংঘ কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন, অর্থনীতিবিদ ও নারী অধিকারকর্মী সালমা খানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহকর্মীর বিদায়ে স্মৃতিচারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ।
সোমবার দুপুরে ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড পেজ থেকে সালমা খানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের স্মৃতিচারণ করে ওই স্ট্যাটাস দেন ড. ইউনূস। তার দেওয়া স্ট্যাটাসটি সমকালের পাঠাকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
সালমার সঙ্গে ৭২ সাল থেকে পরিচয় এবং একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার শুরু। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যোগদানের দিন থেকে। সালমাও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। তার স্বামী রাণু ভাইয়ের সঙ্গে এবং তাঁর ভাই জামিল চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় আরো আগে থেকে। নানা কর্মসূচি নিচ্ছিলাম অর্থনীতি বিভাগকে প্রাণচঞ্চল করার জন্য। সালমার সব বিষয়ে উৎসাহ। তার বাসায় নাস্তাপানির প্রণোদনা বরাবর আমাদেরকে একত্র করতে নিশ্চিতভাবে সাহায্য করে গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আমি চলে গেলাম টাংগাইলে ৭৮ সালে। গ্রামীণ ব্যাংকের টাংগাইল পর্ব শেষ করে যখন ঢাকায় আসলাম ততদিনে সালমারাও ঢাকায় চলে এসেছে। ঢাকায় এখন শুধু একা সালমা নয় তার পুরো পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। সালমা নাজমা আমার বিয়ে নিয়ে মেতে পড়লো।
সালমা-রাণু খানের বাসা হয়ে উঠলো আমাদের স্থায়ী বৈঠকখানা।
সালমা ইতিমধ্যে নানাদিকে নিজেকে বিস্তৃত করতে আরম্ভ করেছে। বিশেষ করে নারী আন্দোলনে। তার কদর সবার কাছে। সালমা স্পষ্টভাষী। কারো মন যুগিয়ে কথা বলার অভ্যাস তার কখনো হয়নি। তার পক্ষের যুক্তিগুলি তৈরী থাকতো জোরালোভাবে। কাজেই পিছু হটতেন না তিনি। নারী আন্দোলন তখন সবেমাত্র দানা বাঁধছে। সালমার সতেজ বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে এই আন্দোলন বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে। সালমা কথায় এবং যুক্তিতে যেকোনো আলোচনা তার পক্ষে নিয়ে আসতে পারতো। যেকোন সভায় বাংলা ইংরেজী যেকোন ভাষায় যুক্তিবহুল বক্তব্য রাখার জন্য সালমার জুড়ি ছিলো না। আমাদের কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতো না সালমাকে সভাপতিত্ব করতে রাজী না করিয়ে।
সিডোকে নিয়ে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন যাতে মহিলাদের জন্য সত্যিকার একটা বিশ্ব চার্টার তৈরী করে দিতে পারেন। বিশ্ব পরিমন্ডলে গিয়ে তিনি হারিয়ে ত যানইনি বরং তিনি তাঁর প্রতিভার উপযুক্ত সত্যিকার কর্মক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। এমন এমন বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনায় বসে যেতেন যেগুলি কীভাবে সমাধান করবেন তা আমার মাথায় আসতো না। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা । সমাধান তার চাইই।
পত্রপত্রিকায় লেখার ব্যাপারেও তিনি এক পায়ে খাড়া। শুধু লেখার জন্য লেখা না। তাঁর বক্তব্য তিনি তুলে ধরবেনই। তা জোরালোভাবেই তুলেছেন।
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলির কাজ তাঁর খুবই পছন্দের ছিল। আমরা তাঁকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বোর্ডের সদস্য করে নিয়েছিলাম। তিনি কোন বোর্ড মিটিংএ অনুপস্থিত থাকতেন না। বরং আগে থেকে খোঁজ নিতেন কোনটার মিটিং কখন হবে যাতে তিনি নিজের প্রোগ্রাম সেভাবে করে নিতে পারেন। তাঁর অসুখের জন্য গত কিছুদিন তিনি মিটিংএ থাকতে পারছেন না বলে বারে বারে আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে গেছেন। কিন্তু এতো কিছু সত্বেও বন্ধু পরিচর্যায় তিনি ক্ষান্তি দেননি। আমরা নিয়মিতরা ত বটেই, বরং নতুন প্রজন্মের বন্ধুরাও এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বাসায় না-গেলে আমার বাসায় তাঁর অপূর্ব স্বাদের কেক পাঠিয়ে মনে করিয়ে দিতেন যে কেন অনেক দিন গেলাম না।
সেই সালমা এখন তুমি একেবারেই আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলে।
এটা মেনে নেবো কীভাবে।
প্রসঙ্গত, গত ২ জুন রাজধানীর গুলশানের বাসায় ইন্তেকাল করেন সালমা খান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
সালমা খান প্রথম এশীয় হিসেবে সিডও কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৯৩ সালে প্রথম নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ (সিডও) সংক্রান্ত জাতিসংঘের সিডও কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সালে আবার দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৭–১৯৯৮ সালে তিনি কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। সব মিলে সিডও কমিটিতে তিন মেয়াদে ১২ বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন সালমা খান। এরপর ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিকাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ে ডিপ্লোমা ও যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেন্ডার প্ল্যানিংয়ে বিশেষায়িত হন।
সালমা খান নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে স্বর্ণপদক পান। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে শ্রেষ্ঠ নারী প্রশাসক হিসেবে অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার এবং নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অসামান্য সেবার স্বীকৃতি হিসেবে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল জিন হ্যারিস পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।