ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

চেক প্রতারণার মামলা

বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ভোগান্তি চরমে

বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ভোগান্তি চরমে

ওয়াকিল আহমেদ হিরন

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২২ | ১২:০০

ঢাকার কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির ২০১৭ সালে সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১১ লাখ টাকার চেক প্রতারণার অভিযোগে (এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায়) ঢাকার আদালতে পৃথক তিনটি মামলা করেন। এরপর আইনগত বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ২০১৯ সালে মামলাগুলো সেশন আদালতে পাঠানো হয়। এখন তিনটি মামলা ঢাকার চতুর্থ যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে আগামী সেপ্টেম্বরে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রয়েছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সোমা খন্দকার। ১০ লাখ টাকার চেক প্রতারণার অভিযোগে তাঁর এক বন্ধুর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার আদালতে মামলা করেন। মামলার একেকটি ধাপ পার হতে লেগে যাচ্ছে ৬ থেকে ৯ মাসের মতো। একপর্যায়ে আদালতে জবানবন্দি দেন মামলার বাদী সোমা। তাঁকে বিবাদীপক্ষের আইনজীবী জেরা করতে চাইলে গত মে মাসে ফের তারিখ পড়ে সাত মাস পরে। চেক প্রতারণার মামলায় হুমায়ুন কবির ও সোমার মতো অসংখ্য ভুক্তভোগী পড়েন পাল্টা ভোগান্তিতে। সৃষ্টি হয় মামলাজট। আবার মামলা চালাতে গিয়ে বাড়ছে ভুক্তভোগীর খরচও।

এসব ঘটনা পৃথক হলেও বিচ্ছিন্ন নয়। এনআই অ্যাক্টে দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটছে অহরহ। এনআই অ্যাক্টের মামলা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য ফৌজদারি মামলা। তৈরি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা, আর্থিক টানাপোড়েন ও পারিবারিক অশান্তি। সারাদেশের আদালতে ৩৮ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন থাকলেও শুধু নিম্ন আদালতে রয়েছে প্রায় পাঁ?চ লাখ চেক জালিয়াতির মামলা। এসব মামলায় বিচারের মুখ দেখেছেন খুব কম বাদীই। বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় বিচারপ্রার্থীর চেকের টাকার চেয়ে মামলায় দ্বিগুণ খরচ হয়ে যাচ্ছে। বিচারপ্রার্থীদের কয়েকজন জানিয়েছেন, চেক প্রতারণার মামলায় দীর্ঘদিন আদালতে ঘোরায় আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে।

জানা যায়, চেক ডিজঅনার মামলার অধিকাংশ বিবাদী থাকেন প্রভাবশালী ও বিত্তবান। এ মামলা জামিনযোগ্য হওয়ায় আইনের ফাঁকফোকর ও উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাঁরা বেরিয়ে যান। ফলে ঝুলে যায় অসংখ্য মামলা। উচ্চ আদালতের নির্দেশেও অধিকাংশ মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকে দীর্ঘদিন। ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে শতাধিক ব্যক্তি চেক জালিয়াতির ফাঁদে পড়ে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এভাবে প্রতিবছর ৫০-৬০ হাজার মানুষ মামলার জালে আটকা পড়েন।

টাকা উদ্ধারের জন্য নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট (এনআই) অ্যাক্ট-১৮৮১-এর ১৩৮ ধারায় চেক প্রতারণার মামলা করা হয়। ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর হাইকোর্টের দেওয়া রায় অনুসারে শুধু যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকরা এ মামলার বিচার করে থাকেন। এসব মামলার অনুসন্ধান বা কোনো তদন্ত হয় না। ফলে মামলার বাদীকে পাওনার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আইনজীবী ও আদালত-সংশ্নিষ্টদের পেছনে খরচ করতে হয়। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একটি চেকের মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (চেক ইস্যুর ছয় মাসের মধ্যে) চেকটি ব্যাংকে নগদায়নের জন্য উত্থাপন করে প্রত্যাখ্যান হয়েছে কিনা, নির্দিষ্ট সময়ে বিবাদীকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে কিনা এবং সঠিক সময়ের মধ্যে মামলা করা হয়েছে কিনা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জে. আর খান রবিন সমকালকে বলেন, দেওয়ানি মামলায় মামলা মুলতবির বিষয়ে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ফৌজদারি মামলার বিচারের ক্ষেত্রে মুলতবির সময়সীমা নির্দিষ্ট নেই। ফলে এনআই অ্যাক্টের মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, মামলার আধিক্যের কারণেই অনেক পরে তারিখ পড়ে। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, অবাক হওয়ার বিষয় হলো- চেকের মামলা ১৩৮ ধারা অনুসারে খুবই সুনির্দিষ্ট। অথচ একেকটি মামলায় ৯ মাস পরেও তারিখ পড়ে। সে ক্ষেত্রে একটি চেকের মামলা শেষ করতে পাঁচ-ছয় বছরও লেগে যায়। এরপর জজকোর্ট থেকে মামলা যায় হাইকোর্টে। এভাবে প্রায় ১০ বছর সময় পার হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, এরপরও বাদী টাকা পাবেন কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে যায়।

চেক প্রতারণার মামলা নিষ্পত্তিতে আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে মত রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির। ঢাকা মহানগর পিপি মো. আবদুল্লাহ আবু সমকালকে বলেন, আগে বেশি সংখ্যক আদালতে মামলা চলত। এখন শুধু যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চেক প্রতারণার মামলার বিচার হয়। মামলার সংখ্যা এত বেশি যে নিষ্পত্তিতে সময় চলে যাচ্ছে। এ জন্য আদালতের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, জরিমানার টাকা কীভাবে আদায় হবে, বাদী কীভাবে তাঁর পাওনা টাকা পাবেন- আইনে এর কোনো সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান বা ব্যাখ্যা নেই। এমন পরিস্থিতিতে চেক ডিজঅনার মামলার অনেক রায় অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। এর কোনো সমাধানও পাওয়া যাচ্ছে না। বিচারপ্রার্থী মানুষের ভোগান্তি অবসানের লক্ষ্যে এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন।

এদিকে, ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের বেশ কিছু সংশোধনীর সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় আইন কমিশন। পাঁচ বছর হতে চললেও তার কোনো অগ্রগতি নেই।

আরও পড়ুন

×