ওরা 'পুরোনো এবিটি'র দীক্ষায় ছাড়ে ঘর

প্রতীকী ছবি
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৪:১৫
দেশে একের পর এক লেখক ও ব্লগার হত্যার পর দুর্ধর্ষ জঙ্গি সংগঠন হিসেবে আলোচনায় এসেছিল আনসার আল ইসলাম। এই সংগঠনটির পুরোনো নাম ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)। অনেক দিন পর আবার নতুনভাবে সামনে আসছে এবিটির গোপন তৎপরতার তথ্য। কুমিল্লা ও সিলেট থেকে সব মিলিয়ে ১৬ তরুণ 'নিখোঁজ' হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে উগ্রপন্থি কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখেন- এমন একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার ধারণা, ব্লগার হত্যায় জড়িত ওই সংগঠনটির দীক্ষা নিয়ে তাঁরা ঘর ছেড়েছেন। সংগঠনের মতাদর্শে বিশ্বাস করে তাঁরা এরই মধ্যে 'হিজরত' করেন। কেউ কেউ গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। দ্রুত তাঁদের আইনের আওতায় আনা না গেলে তাঁরা যে কোনো সময় ভয়ংকর কোনো ঘটনাও ঘটাতে পারেন বলে আশঙ্কা গোয়েন্দাদের।
প্রথম দফায় কুমিল্লা থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে দুই সপ্তাহের বেশি নিখোঁজ আছেন ৯ তরুণ। তাঁদের খোঁজ না পেয়ে পরিবার দিশেহারা। এরই মধ্যে আরও চার তরুণের সন্ধান মিলল। তাঁদের বাড়িও কুমিল্লায়। তাঁরাও এবিটির মতাদর্শে বিশ্বাসী। ওই চারজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ঘর ছাড়ার প্রস্তুতি নেওয়ার তথ্য জানার পর ওই চারজনকে ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন কর্মসূচির আওতায় জঙ্গিবিরোধী উদ্দীপনা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে তুলে দিয়েছে র্যাব। পরিবারও চারজনকে কাছে পেয়ে আনন্দিত।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সমকালকে বলেন, প্রথম দফায় কুমিল্লা থেকে যে সাতজন নিখোঁজ হয়েছিলেন, তাঁদের খোঁজ পেতে র্যাবের সহায়তা চায় পরিবার। তারা জিডিও করেছিল। সাতজনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, একই এলাকার আরও চারজন বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন। দ্রুত তাঁদের আটক করে জঙ্গিবিরোধী কর্মসূচির মাধ্যমে দীক্ষা দিয়ে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। নিখোঁজ অন্যরা কোথায় রয়েছেন, তা জানার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এবিটির যে গ্রুপটির মাধ্যমে মগজ ধোলাইয়ের পর ওই তরুণরা বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, তাঁদের কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। প্রথমে তাঁরা যেসব আস্তানায় উঠেছিলেন, তেমন কয়েকটির খোঁজও মিলেছে।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, নিখোঁজ তরুণদের সংগঠনে দলভুক্ত করতে একটি কৌশল নিয়েছিল তারা। হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়ার কয়েক মাস আগে থেকেই তাবলিগে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের করা হয়। এরপর গোপন আস্তানায় রেখে তাঁদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে সাত তরুণ নিখোঁজ হন। তাঁরা হলেন- কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল (১৭), একই কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মোহাম্মদ আস সামি (১৮), কুমিল্লা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম (১৮), একই কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নিহাল আবদুল্লাহ (১৭), ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯), একই কলেজের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের আমিনুল ইসলাম আলামিন (২৩) ও ঢাকা ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করা সরতাজ ইসলাম ওরফে নিলয় (২৫)। এই সাত শিক্ষার্থী নিখোঁজের ঘটনায় কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় পাঁচটি ও ঢাকায় একটি জিডি হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত তাঁদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর আগে চলতি বছরের শুরুতে সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের (ইইই) ছাত্র ছিলেন শেখ আহমদ মামুন (২০)। ৯ মাস ধরে তাঁর কোনো খোঁজ নেই। পরিবারের পক্ষ থেকে ওসমানীনগর থানায় জিডিও করা হয়। মামুনের সঙ্গে একই দিন ঘর ছেড়েছিলেন সিলেটের আরও তিন তরুণ। তাঁদের হদিস এখনও মেলেনি। ওই সময় সব মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৯ তরুণের নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। সর্বশেষ কুমিল্লা থেকে সাত তরুণের নিখোঁজের ঘটনার পর সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত হদিস নেই ১৬ জনের। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা সবাই এবিটির ফাঁদে পা দিয়েছেন।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, আনসার আল ইসলাম কয়েকটি উইংয়ের মধ্য দিয়ে তাদের কার্যক্রম চালায়। তা হলো দায়ী বা দাওয়াতি বিভাগ, আশকারি বা মিডিয়া উইং, আইটি, ইন্টেলিজেন্স ও অপারেশন্স বিভাগ। যাঁরা সংগঠনের আদর্শকে বিশ্বাস করেন, তাঁদের বলা হয় মাদু বা সমর্থক। এরপর প্রাথমিক পূর্ণ সদস্য। তাঁদের বলা হয় ইখওয়াহ। চার-পাঁচজন ইখওয়াহ মিলে তৈরি হয় তৈইফা বা সেল। একে মডিউল বা স্লিপার সেলও বলা হয়ে থাকে। প্রতিটি সেলে একজন দায়িত্বশীল বা মাসুল থাকে। তিন-চারটি সেল নিয়ে তৈরি হয় একেকটি সেকশন। সেকশন নিয়ে তৈরি হয় যে প্ল্যাটফর্ম, তাকে বলা হয় মামুর। কয়েকজন মামুর মিলে তৈরি হয় হেড অব সেকশন। আনসার আল ইসলামের পুরো কার্যক্রম কাটআউট পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। এক তৈইফার সদস্যরা আরেক তৈইফার সদস্যের ব্যাপারে কোনো তথ্য জানে না। কাউকে হত্যার জন্য টার্গেট করা হলে তার ব্যাপারে তথ্য আনসার আল ইসলামের ফতোয়া বোর্ডে পাঠানো হয়। ফতোয়া বোর্ড তাদের মতামত দিয়ে তা শূরা বোর্ডের কাছে পাঠায়। এরপর হত্যার জন্য সর্বশেষ কাজটি সম্পন্ন করে অপারেশনাল ইউনিট।
- বিষয় :
- জঙ্গি
- জঙ্গি সংগঠন
- আনসার আল ইসলাম