ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

নারীর প্রতি সহিংসতা

নিষ্ক্রিয়তার বিপজ্জনক মাশুল

নিষ্ক্রিয়তার বিপজ্জনক মাশুল

গ্রাফিক্স :: বোরহান আজাদ

 শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫ | ০০:৫৯ | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৫ | ০১:০০

সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। সেই ক্ষত এখনও শুকায়নি; এর মধ্যেই ভোলা থেকে উঠে আসে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা– স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ। আক্রান্ত নারী জানান, তাঁর স্বামীকে নির্যাতন করে অর্থ আদায়ের জন্য তাঁকে ডেকে নেওয়া হয় এবং তারপর নৃশংস নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাঁকে।
এসব ঘটনায় যেন সাম্প্রতিক বাংলাদেশে নারীর নিরাপত্তাহীন অবস্থার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৪০১টি। অথচ চলতি বছর ২০২৫-এর প্রথম ছয় মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪১টি। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।
অধিকারকর্মীদের মতে, এসব ঘটনা নিছক অপরাধ নয়– এগুলো নারীর প্রতি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিদ্বেষের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। আইন ও মানবাধিকারের মৌলিক ভিত্তিকে পদদলিত করে এ সহিংসতা। এখনকার পরিস্থিতি বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সংকটজনক– এমনটাই মত মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর।
মুরাদনগরের ঘটনার পর কিছু মানুষ ধর্ষণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, কেউ বলেছে পরকীয়ার কথা। অথচ আক্রান্ত নারীকে তাঁর পরিবারের সামনে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়; যা সরাসরি নাগরিক নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার ভয়াবহ সংকট তুলে ধরে।
এই মানসিকতা নতুন নয়– যখনই কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হন, তখনই শুরু হয় তাঁর চরিত্র হননের এক অশুভ প্রচেষ্টা। কখনও বলা হয়– রাতের বেলা বাইরে বের হয়েছিলেন কেন, কখনও বলা হয়– সে হয়তো রাজি ছিল। ২০১১ সালের ভিকারুননিসার পরিমলকাণ্ড থেকে শুরু করে ২০২১ সালের কলাবাগান কিংবা সিলেটের এমসি কলেজ অথবা সাম্প্রতিক মুনিয়া হত্যাকাণ্ড– প্রতিটি ঘটনায় দেখা গেছে, নারীকে দোষারোপ করার এক ভয়াবহ প্রবণতা।
কথাসাহিত্যিক শাহ্‌নাজ মুন্নী এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার এই প্রবণতা নারীর প্রতি আমাদের নেতিবাচক সামাজিক মনোভাবকেই তুলে ধরে। এর পেছনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতা অবশ্যই একটি বড় কারণ। সর্বব্যাপী পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো নারীদেরও নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। সমাজ নারীকে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় বলে মনে করে। সুরক্ষার নামে নারীকে অধীনতার শিকলে বন্দি করে রাখতে চায়। সমাজ সবসময় নারীকে ভাবতে বাধ্য করে বাইরের দুনিয়ায় সে অনিরাপদ। নারীকে শেখানো হয় তাঁর সম্মান তাঁর শরীর ও যৌনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে শ্লীলতাহানি হলে সেটি নারীরই লজ্জা।’
প্রতিদিনের এই সহিংসতা কেবল ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত সংকটের বহিঃপ্রকাশ। মুরাদনগরের ঘটনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই অপরাধের পেছনে কেবল ব্যক্তি নয়, বরং সরকারের নির্লিপ্ততা ও দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা কাজ করছে। একজন নারী তাঁর নিজ ঘরে, নিজ পরিচয়ে সুরক্ষিত না থাকলে, তা রাষ্ট্রের সীমাহীন ব্যর্থতা ও নিরাপত্তাহীনতা নির্দেশ করে। অতীতে নারীর ওপর হামলা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনায় বিচার বিলম্বিত বা অপরাধীদের রক্ষা করার যে প্রবণতা দেখা গেছে, এ ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা বলে বিবেচিত হতে পারে।


মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১১ মাসে ধর্ষণ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৭৮০টি, যার মধ্যে ৫৫৮টি ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৭৩৬ শিশুসহ মোট ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী-কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৮১ জন ধর্ষণের শিকার, ৩২০ জন নারী খুন হয়েছেন এবং শুধু জুন মাসেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন
২০৩ জন।
একই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ছয় মাসে ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৪ কিশোরী। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৭ জনকে। যৌন নিপীড়নের শিকার ৫১ জন। ৩১ জনকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে। উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন। ২১ নারী ও কন্যাশিশু পাচার হয়েছেন। একজন এসিড সন্ত্রাসের শিকার। ৬১ কন্যাসহ হত্যার শিকার হয়েছেন ৩২০ নারী ও কন্যাশিশু।
এই ভয়াবহ চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে যখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উচ্চপর্যায়ের প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত আসে না, তখন এটিকে কেবল অবহেলা নয়– রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা হিসেবেই দেখা যায়।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম যেমনটি বলেন, ‘এ পরিসংখ্যান শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি। বিশেষ করে কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা ও দলবদ্ধ ধর্ষণের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এটি সমাজের জন্য অ্যালার্মিং।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছয় মাসে হাজারের বেশি নারী-কন্যা নির্যাতনের শিকার হলেও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় বা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আছিয়া ধর্ষণ মামলায় তড়িঘড়ি করে বিচার হয়েছে, কিন্তু ভালো তদন্ত না হওয়ায় পরিবার সন্তুষ্ট নয়। এ ধরনের বিচারে দ্রুততা নয়, নির্ভুলতা জরুরি।’
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান আরও সরাসরি বলেন, ‘খুবই উদ্বেগজনক ধর্ষণের চিত্র, নারী নির্যাতনের চিত্র। সার্বিকভাবে নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন সার্বিকভাবে বেড়ে চলছে এবং উদ্বেগজনভাবে রাষ্ট্র দায়িত্ব নিচ্ছে না। আমাদের উদ্বেগটা এটিই। রাষ্ট্র ঝাঁপিয়ে পড়ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। সেই জিনিসটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যার ফলে যারা এ জিনিসগুলো করছে, তারা কোনো ভয় পাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতার চার ভাগের এক ভাগও মিডিয়ায় আসে না। শুধু আলোচিত ঘটনাগুলো সামনে আসে। যদি অপরাধীরা প্রভাবশালী হয়, অনেক সময় সেগুলোর খবরও পাওয়া যায় না।’
এ সমাজে নারী হয়ে বেঁচে থাকাই যেন আজ এক সাহসিকতার কাজ। প্রতিদিনের খবরের শিরোনামে পরিণত হওয়া এই নারীদের গল্প কেবল নির্যাতনের নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতার দলিল। রাষ্ট্র যদি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের মৌলিক ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এখন সময় সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার, জবাবদিহিতার। নারীর শরীর নয়, তাঁর সম্মান ও অধিকারকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব পুনর্নির্ধারণ করার। v

আরও পড়ুন

×