এমটিএফইর আগে শত কোটি টাকা হাতিয়েছে এসবিএল-রিং আইডি

সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৩ | ২১:৫৩ | আপডেট: ২২ আগস্ট ২০২৩ | ২১:৫৩
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর যদুবয়রা এলাকার বাসিন্দা রঞ্জু আহমেদ অনেক দিন ধরে বালুর ব্যবসা করেন। মাস তিনেক আগে তিনি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) নামে একটি ভার্চুয়াল কোম্পানির কথা জানতে পারেন। মঙ্গলবার রঞ্জু বলেন, ‘দেখলাম, এলাকার অনেকেই এমটিএফইতে আইডি খুলে টাকা আয় করছে। তারা বলেছিল, এটি ইসলামী শরিয়তভিত্তিক কারবার; বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি কোনো জালিয়াতি করবে না। ৫৫-৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে দিনে ৫০০ টাকা লাভ দেওয়া হবে। তখন গরু বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করি। প্রথম দুই মাস ঠিকঠাক লাভ পেয়েছি। ডলারে বিনিয়োগের পর লাভের টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তুলেছি। হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে গেলাম। চালান, লাভ– সব হারালাম। লোভে পড়ে সব শেষ আমার।’
রঞ্জুর মতো দেশের বিভিন্ন জেলার লাখো মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কয়েক হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে দুবাইভিত্তিক এমটিএফই। যারা টাকা খুইয়েছেন, তারা ভয়ে মামলা দিতেও যাচ্ছেন না। ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের জালে জড়ানোয় উল্টো মামলার ভয়ে তারা। কারণ, ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন বাংলাদেশে অবৈধ।
সমকালের তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এমটিএফইর আগে একই ধরনের অন্য প্রতিষ্ঠানের ফাঁদে পড়ে কোটি কোটি টাকা হারিয়েছে শত শত মানুষ। এমন দুটি প্রতিষ্ঠান হলো এসবিএল ও রিং আইডি। প্রতিষ্ঠান দুটি মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও আশপাশের কিছু জেলায় গ্রামের লোকজনকে ফাঁদে ফেলে শতকোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে। এসবিএলের ফাঁদে পা দেওয়া একজন সমকালকে বলেন, কুমারখালীতে ইমরান নামে এক হাফেজ এসবিএলে যুক্ত ছিলেন। মাদ্রাসায় পড়েছেন এমন কয়েকজন নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে এসবিএলে বিনিয়োগ করতে বলতেন তিনি। এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে মাসে ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেন। লোভে পড়ে অনেকেই তখন এসবিএলে বিনিয়োগ করেন। কোম্পানিটি উধাও হয়ে যাওয়ার পর রিং আইডি নিয়ে অনেকে প্রচারণা শুরু করেন। আর সর্বশেষ এ ধরনের কোম্পানি ছিল এমটিএফই।
এমটিএফইতে যাদের অ্যাকাউন্ট ছিল, তারা মূলত মোবাইল অ্যাপে লাভের টাকার হিসাব রাখতেন। অ্যাপ থেকেই টাকা তোলা যেত। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা জমা বা তোলার ব্যবস্থা থাকলেও অধিকাংশ মানুষ কোম্পানির প্রতিনিধি বা যার মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, তার সঙ্গে লেনদেন করতেন। এটি ছিল ডেসটিনির মতো বহুধাপ বিপণন (এমএলএম) কারবার। লাভের অঙ্ক সবার মধ্যে ভাগ হতো। ফাঁদে ফেলতে শুরুতে সবাইকে নিয়মিত মুনাফা দেওয়া হয়। এর পর বেশি লাভের আশায় অনেকে বেশি টাকা বিনিয়োগ করেন। কিছুদিন থেকে তারা কেউ আর টাকা তুলতে পারছিলেন না। প্রথমে তাদের অ্যাকাউন্টে কিছু ডলার দেখানো হলেও পরে তা উধাও হয়ে যায়।
আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন বুঝব না বলে এজেন্টরা সবকিছু অ্যাপে ঠিক করে দিতেন। লোকাল এজেন্টদের টাকা দিতাম। অনেকেই টাকা পেয়েছে দেখে বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু মাস খানেক ধরে টাকা ওঠানো যাচ্ছিল না। তারা বলেছিল, কারিগরি উন্নয়নের জন্য টাকা উত্তোলন বন্ধ আছে। ১৭ আগস্ট থেকে সবকিছু উধাও।’
কে এই মাসুদ আল ইসলামএমটিএফইর মাধ্যমে ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা এ ঘটনায় দুবাইপ্রবাসী বাংলাদেশি মাসুদ আল ইসলামকে দায়ী করছেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। তারা বলছেন, ভার্চুয়ালি নানা প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষকে এই নেটওয়ার্কে যুক্ত করেন মাসুদ। এমটিএফই নিয়ে সেমিনার ও মিটিং আয়োজনের জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের তিন শতাধিক সিইও রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থা এখন ওই সিইওদের খোঁজ নিচ্ছেন।
তবে আলোচিত মাসুদ আল ইসলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভে এসে দাবি করেন, ‘গত বছরের মার্চে দুবাই এসেছি। তখন আমার কাছে মাস খানেক চলার মতো টাকা ছিল। আমি কখনও বলিনি, এমটিএফইতে বিনিয়োগ করুন। আমি কী করছি, সেটা কেউ জানতে চাইলে এমটিএফইর কথা বলতাম। ৩০ ডলার দিয়ে এমটিএফইতে কারবার শুরু করি। জুম মিটিংয়ে অনেককে এও বলেছি, আগ্রহী হলে আগে বোঝেন, তারপর ধীরে ধীরে বিনিয়োগ করেন। এটি আমার বা আমার বাবার কোম্পানি নয়। কেন কাউকে লাখ লাখ ডলার বিনিয়োগের কথা বলব? এখন বাংলাদেশের অনেকেই বলছেন, এটা আমার কোম্পানি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি শুক্রবার জুম মিটিংয়ে সতর্ক করতাম, কোনো একদিন সকালে যদি উঠে দেখেন– এমটিএফই উধাও, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এটা মেনে নিতে পারলে কারবার করেন। আমি সিইও হওয়ার আগে ফেনী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমার মতো দু’জন সিইও ছিলেন। তাদের দেখে আমি উদ্বুদ্ধ হই। আপনাদের মতো আমিও স্বপ্ন নিয়ে এসেছি। যখন একটু ভালো অবস্থানে এলাম, তখন এত বড় লস! ৮০ শতাংশ লোক তাদের বিনিয়োগ তুলে নিতে পেরেছে। কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিসের মেসেজ আমি সবাইকে টেলিগ্রাম অ্যাপে জানাই। এটা এখন আমার কাল হয়েছে।’
এ ব্যাপারে কুমিল্লার পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান বলেন, ‘কুমিল্লায় এমটিএফইর মাধ্যমে অনেককে ফাঁসানো হয়েছে। মাসুদের ব্যাপারে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি।’ সিআইডির সাইবার ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি এস এম আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘এ ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি। তবে আমরা ছায়াতদন্ত শুরু করেছি।’
নাইজেরিয়া থেকে আত্মসাৎ ১১ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশিদের সঙ্গে প্রতারণার আগে বিশ্বের আরও অন্তত ৩০টি দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমটিএফই। এর মধ্যে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার অনেক দেশ রয়েছে। নাইজেরিয়ার গণমাধ্যমের খবর, এমটিএফই দেশটি থেকে আত্মসাৎ করেছে একশ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। শ্রীলংকার গণমাধ্যমে প্রকাশ– দেশটি থেকে একই চক্র একশ কোটি রুপি হাতিয়ে নিয়েছে।
আগেই সতর্ক করেছিল কানাডা
কানাডার ‘কোম্পানিজ ডিরেক্টরি’ নামে একটি ওয়েবসাইটে এমটিএফই সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে নিবন্ধন নম্বর, কতদিন ব্যবসা করছে, এমন কিছু তথ্য আছে। কানাডার একটি জার্নালে বলা হয়, কোম্পানিটি ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। এর প্রধান নির্বাহী র্যান্ডি ম্যাথিউ লেইন। এ ছাড়া কানাডার ওন্টারিও সিকিউরিটিজ কমিশন গত জুলাইয়ে এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৪টি কোম্পানির সঙ্গে লেনেদেনে সতর্কতা জারি করে। তার মধ্যে এমটিএফই ছিল। তবে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাল– তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তদন্ত শুরু
ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে পালানোর পর এমটিএফইর পরিচালকদের সম্পদের খোঁজে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। ফরেক্স ট্রেডিংয়ের নামে সংগ্রহ করা অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বাইরে নিয়ে লাপাত্তা তারা। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নিবাহী কর্মকর্তা মাসুদ আল ইসলাম ছাড়াও আরও দুই পরিচালক ওমরাহ হজের নামে পাড়ি দিয়েছেন সৌদি আরব। সংশ্লিষ্টরা জানান, এমটিএফইর মতো ফরেক্স ট্রেডিংয়ের অনেক প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। এ ধরনের ট্রেডিং অবৈধ উল্লেখ করে বিভিন্ন সময়ে সতর্ক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরও বেশি লাভের আশায় মানুষ বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক ভার্চুয়াল সম্পদ বা মুদ্রার বিনিময়, স্থানান্তর বা ট্রেড নিষিদ্ধ করেছে। নির্দেশনা অমান্য করে কেউ এ ধরনের লেনদেন করলে তা হবে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধ করলে হতে পারে সাত বছরের জেল বা আর্থিক জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত।
অনেকেই ফেঁসেছেন
ডেসটিনি, যুবক, মধুমতির মতো প্রতারণার পর ডিজিটাল মাধ্যমে এমটিএফইর ফাঁদ তৈরি হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সেখানে পাঁচ শতাধিক মানুষ রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে বিনিয়োগ করে সব হারিয়েছেন। মাসুদ আল ইসলামের হাত ধরেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই প্রতারণা শুরু করেন শিবগঞ্জ উপজেলার তরিকুল ইসলাম। এই তরিকুল ইসলাম প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়েছেন প্রায় ৫০ কোটি টাকা। রাজশাহী ও ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে তাঁর নেটওয়ার্ক। তরিকুল ইসলামের আওতায় অনেক সিইও কাজ করেন। তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি চার মাস আগেই এমটিএফই ছেড়ে দিয়েছি। সরকারি এক কর্মকর্তা আমাকে এমন প্রতারণার কাজ করতে নিষেধ করেছিলেন। সেদিন থেকে আমি কোনো প্রোগ্রাম করিনি। আমি আগেই বুঝতে পেরেছি যে, এটা বড় ধরনের ফাঁদ। এ জন্য আমি যাদের যুক্ত করিয়েছিলাম, তাদের পরিষ্কারভাবে বিনিয়োগ উঠিয়ে নিতে বলেছি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অন্তত ১০ জন সিইও আছেন। এ ছাড়া আমার কাছে আর কোনো তথ্য নেই।’
দুমকীতেও ছিল প্রতারণার জাল
এমটিএফই অ্যাপের সিইও হিসেবে পরিচিত দুমকী উপজেলার এবিএম আকলাখুর রহমান। তাঁর খপ্পরে পড়ে দুমকীর আবুল কালাম হারিয়েছেন ৬ লাখ টাকা, সরোয়ার হোসেন ৪ লাখ, গ্রামীণ ব্যাংক সড়কের রুবেল গাজী ১ লাখ ২০ হাজার, বশির হাওলাদার ১ লাখ ২০ হাজার, আলামিন হোসাইন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়াও অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। এমটিএফই অ্যাপের সিইও আকলাখুর রহমান বলেন, ‘আমার ইউনিভার্সিটির এক বড় ভাই আমাকে লিঙ্ক দিয়েছিলেন। তা ছাড়া আমি নিজেও একজন ভুক্তভোগী, আমার ১৭ লাখ টাকা এখানে বিনিয়োগ ছিল। আজ আমি নিঃস্ব। প্রথমদিকে লাভজনক ছিল বিধায় আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুকে উদ্বুদ্ধ করি। এ ব্যাপারে দুমকী থানার ওসি (তদন্ত) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে এখনও কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। থানায় কোনো মামলাও করেননি। কোনো ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।