পেঁয়াজ কারসাজি
রাঘববোয়ালের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না প্রশাসন

ভারত থেকে আলু আমদানি বন্ধ হয়ে গেল। শেষ দিন বৃহস্পতিবার আলুবাহী বেশ কিছু ট্রাক হিলি স্থলবন্দর দিয়ে দেশে আসে -সমকাল
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০০:৪৯ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৭:৫৩
ভারত থেকে আসা প্রতি কেজি পেঁয়াজ পরিবহন খরচসহ আমদানি খরচ পড়ে ৯০ টাকা। তবে পাশের দেশের রপ্তানি বন্ধের খবরে সেই পেঁয়াজ কয়েক দিন বেচাকেনা হয়েছে সর্বোচ্চ ২২০ টাকা দরে। চীন থেকে আমদানি করা পেঁয়াজে সব মিলিয়ে খরচ পড়ে ৫৫ টাকা। এই পেঁয়াজও বিক্রি হয়েছে দ্বিগুণের বেশি; ১৩০ টাকায়। কৃত্রিম সংকটের জাল বিছিয়ে পাঁচ দিনে ক্রেতার পকেট থেকে শতকোটি টাকা বের করে নিয়েছে ৫০ থেকে ৬০ আমদানিকারকের সিন্ডিকেট। চট্টগ্রাম, বেনাপোল, হিলি, সোনামসজিদ, ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা পেঁয়াজ মজুত রেখে দাম বাড়িয়েছে এ চক্র। এমন কারসাজিতে সায় দিয়েছে কমিশন এজেন্টরাও। বারবার একই চক্র মিলেমিশে এমন অপকর্ম করলেও তারা সবসময় থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ভারতের রপ্তানি বন্ধের পর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও স্বীকার করেছিলেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ে কেউ কেউ কারসাজি করছে। এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছে বিভিন্ন সংস্থা। এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলমও বলেছিলেন, দেশে পেঁয়াজের দাম হুহু করে বাড়ার কারণ ছিল না। অভিযানের পর আবার দাম কমতে শুরু করেছে। তার মানে কোথাও কারসাজি হয়েছে।
সিন্ডিকেটে কারা
পেঁয়াজের এই সিন্ডিকেটে আছে ভোমরা স্থলবন্দরের ২০ থেকে ২৫ জন, সোনামসজিদ স্থলবন্দরের ২০ থেকে ২২ জন এবং হিলি স্থলবন্দরের ১২ থেকে ১৫ আমদানিকারক। গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, এই চক্রে আছে খাতুনগঞ্জের ১০ থেকে ১২ জন বড় কমিশন এজেন্টও। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পরপরই দেশে থাকা পেঁয়াজ মজুত করে দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ায় তারা।
ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিকারকদের মধ্যে রয়েছে– মেসার্স জিসান এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স নিশি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ঘোষ এজেন্সি, মেসার্স আর ডি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সোহা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সাহা অ্যান্ড কোম্পানি, মেসার্স সুন্দরবন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স দীপা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সুপ্তি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সাহা বন্দর, মেসার্স রহমান ইমপেক্স, ফিরোজ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স বাবা লোকনাথ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মা বাণিজ্যালয়, মেসার্স নাঈম এন্টারপ্রাইজ, রিয়াজ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সাইফুল এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মরিয়ম এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স শামীন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ব্রাদার্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এবং মেসার্স ব্রাদার্স ইমপেক্স।
সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আনা শীর্ষ আমদানিকারকের মধ্যে আছে– মেসার্স আলী রাইস মিল, মেসার্স ইয়াছিন ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স নূর এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স এসএম এক্সিম, মেসার্স গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মেজবাহ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স বিসমিল্লাহ ডাল মিল, রুবেল ট্রেডার্স, মেসার্স রিজু রিতু এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স আরএম এগ্রো, মেসার্স বি এইচ ট্রেডিং অ্যান্ড কোম্পানি, মেসার্স টাটা ট্রেডার্স, মেসার্স আলী এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স খাদিজা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স নিহা বাণিজ্যালয়, মেসার্স সাজ্জাদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ফুল মোহাম্মদ ট্রেডার্স, মেসার্স রাইসা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স কেপি ইন্টারন্যাশনাল এবং মেসার্স টিএম এন্টারপ্রাইজ।
হিলি স্থলবন্দরের শীর্ষ আমদানিকারকের মধ্যে রয়েছে– মেসার্স টুম্পা ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স দ্রুব ফারিয়া ট্রেডার্স, মেসার্স সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স এস কে রাইস মিল, মেসার্স এম আর ট্রেডার্স, মেসার্স খান ট্রেডার্স, মেসার্স সততা বাণিজ্যালয়, মেসার্স ইউনাইটেড রাইস মিল, মেসার্স জগদীশ চন্দ্র রায়, মেসার্স সালাহ ট্রেডার্স, মেসার্স এনপি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এবং মেসার্স রায়হান ট্রেডার্স। এ ছাড়া বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে মেসার্স আল্লার দান ফুড এজেন্সি, সোনালি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স হামিদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সিদ্ধার্থ এন্টারপ্রাইজ এবং চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মেসার্স উষা ট্রেডিং, মেসার্স এএমআর ট্রেডিং এর আগে সর্বোচ্চ পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করেছে।
কারসাজির হোতারা পার পাচ্ছে বারবার
পেঁয়াজ কারসাজিতে আগে যাদের নাম এসেছিল তাদের কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। গত দুই বছরে কারসাজির সঙ্গে অনেকের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় প্রশাসন। এমন এক সিন্ডিকেটে আছে খাতুনগঞ্জের হোসেন ব্রাদার্স, মেসার্স আল্লার স্টোর, মেসার্স আজমীর ভান্ডার ও মেসার্স সৌরভ এন্টারপ্রাইজ, কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কাদের, টেকনাফের আমদানিকারক সজিব, জহির, সাদ্দাম এবং মেসার্স আলীফ এন্টারপ্রাইজ। বেনাপোল, হিলি, সোনামসজিদ, ভোমরা স্থলবন্দরের সঙ্গে যোগসাজশ আছে তাদেরও। তবে এদের কারও কখনও শাস্তি হয়নি। এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এদের নাম-পরিচয় পাঠিয়েছিল চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। তবে কারও টিকিটিও ছুঁতে পারেনি প্রশাসন।
পাঁচ দিনে হাওয়া শতকোটি টাকা
পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বাড়িয়ে দিয়ে পাঁচ দিনে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে পেঁয়াজ সিন্ডিকেট। প্রতি কেজি পেঁয়াজে দ্বিগুণের বেশি লাভ করেছে তারা। এখনও বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। তবে এখন আগের চেয়ে দাম কিছুটা কমেছে। গত শনি ও রোববার পেঁয়াজ নিয়ে একচেটিয়া খেলেছে কারসাজির হোতারা। অথচ ওই দু’দিনে ভোক্তা অধিদপ্তরের ৪৩টি দল সারাদেশে অভিযান চালিয়ে ৮০টি কোম্পানিকে মাত্র পৌনে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করে। যাদের জরিমানা করা হয়েছে তারা সবাই চুনোপুঁটি। রাঘববোয়ালরা এবারও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি শেষ হওয়ার পর বাজারে মুড়িকাটা ও আগাম মৌসুমের পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে। পুরোদমে এমন পেঁয়াজ ওঠা শুরু হলে তা আগামী তিন মাসের চাহিদা পূরণ করতে পারবে বলে আশা কৃষি মন্ত্রণালয়ের। দেশে প্রতি মাসে প্রায় দুই লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা থাকলেও আগামী তিন মাসে মুড়িকাটা ও আগাম মৌসুমের আবাদ থেকে প্রায় আট লাখ টন পেঁয়াজ পাওয়ার আশা করছে মন্ত্রণালয়।
নিয়ন্ত্রণে খাতুনগঞ্জের বাজার, কমছে দামও
বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসতে শুরু করায় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে দাম কিছুটা কমছে। পাইকারি এই মোকামে প্রতি কেজি মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। এক দিন আগেও যা বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকা। অন্যদিকে ভারতীয় পেঁয়াজ নেমে এসেছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে। ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পর ২২০ টাকা পর্যন্ত চড়েছিল এই দাম। এখন চীনা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। তবে খুচরা বাজারে এ দামের তেমন প্রভাব পড়েনি এখনও। খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, ‘শনি ও রোববারের চেয়ে এখন কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। তবে আগের তুলনায় বাজারে ক্রেতার সংখ্যাও অনেক কম।’
- বিষয় :
- পেঁয়াজ
- পেঁয়াজের দাম
- পেঁয়াজের বাজার