স্বপ্ন দেখাচ্ছে কৃষি পর্যটন

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে বিএডিসির ডাল ও তৈলবীজ বর্ধন খামার। ছবি: সমকাল
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ২২:৪৮
সারি সারি লেক। পানিতে মাছের লুকোচুরি। ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস সাঁতার কাটছে। ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির। লেকের ভাঁজে ভাঁজে খেজুর, পেঁপে, নারকেল, আনারস, আপেল, কমলা, মাল্টা আর লেবুগাছ। আছে কাজুবাদাম আর কফিগাছও। সুবাস ছড়াচ্ছে গোলাপ, গন্ধরাজ, শিউলি, অপরাজিতা, নীলকণ্ঠ, সাদাকণ্ঠ, মাধবীলতা, হাসনাহেনা, বেলি, রক্তকরবীসহ মনভোলানো ফুল। লেকের ওপর হাঁস-মুরগির খামার। আরেকপাশে গরু-মহিষ-ভেড়ার চাষ। চোখ জুড়াচ্ছে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। চারপাশ রঙিন করে তুলেছে সরিষা আর সূর্যমুখী। আছে নানা জাতের ঔষধি গাছ। কোথাও গাঢ় জঙ্গল, তাতে সারিবদ্ধ সবুজের মিতালি। নয়নাভিরাম এ চিত্র নোয়াখালীর সুবর্ণচরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ডাল ও তৈলবীজ বর্ধন খামারের। এক সময়ের বনদস্যুকবলিত এলাকাটি এখন কৃষি পর্যটনের নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। বিনামূল্যে ঘুরে দেখছেন কৃষির বৈচিত্র্য।
সারি সারি উঁচু-নিচু পাহাড়-টিলা। ভাঁজে ভাঁজে আনারস, কমলা, মাল্টা আর লেবুগাছ। আছে কাজুবাদাম আর কফিগাছও। টিকিট কেটে মানুষজন ফলবাগানে ঢুকছেন, ঘুরছেন, দেখছেন। টিলায় বসে অনেকেই কিনে খাচ্ছেন টাটকা আনারস আর লেবুর জুস। কেউ কেউ কিনে ব্যাগ ভরে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতেও। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেল। উপজেলার দত্তরাইল গ্রামে পাহাড়-টিলা ঘিরে কৃষি পর্যটন গড়ে উঠেছে। এসব টিলা আগে অনাবাদি ছিল। গত দুই বছরে দৃশ্যপট বদলে যায়। পতিত পাহাড়-টিলা ভরে গেছে আনারসের চারায়। এখন আনারস বিক্রি করেই কোনো কোনো চাষি বছরে কোটি টাকা আয় করছেন। এসব ফলবাগানের উদ্যোক্তাদের প্রায় সবাই প্রবাসী।
শুধু নোয়াখালী আর সিলেট নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন দৃষ্টিনন্দন কৃষিভিত্তিক খামার গড়ে উঠেছে। এগুলো দেখতে পর্যটকদের আগ্রহের শেষ নেই। অথচ দেশে কৃষি পর্যটনের বিকাশ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন অঞ্চলকে মূলধারার পর্যটন খাতের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও দেশের কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রেও কৃষিভিত্তিক পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ শিল্পকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে স্থানীয় মানুষের জীবনমানেও ইতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে দেশের পর্যটন খাত আরও সমৃদ্ধ হতো বলে মনে করেন পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ইতোমধ্যে বান্দরবনের লামা, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু ইকোভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগান, দিনাজপুরের লিচু বাগান, স্বরূপকাঠির পেয়ারা বাগান, যশোরের ফুলের বাগান, নরসিংদীর লটকন বাগান- এমন আরও অসংখ্য কৃষি পর্যটন। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের জন্য এই জায়গাগুলো এরই মধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করে ফেলেছে। যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে এই ক্ষেত্রগুলো আরও প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নীতি কাঠামোতে কৃষি পর্যটন স্বীকৃত। জাতীয় কৃষি নীতিমালা ২০১৮ এবং জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা ২০২০ কৃষি পর্যটনকে উন্নত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনার কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। অথচ এখনও কৃষিকে পর্যটন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘বাংলাদেশের ২ কোটি কৃষক যদি সপ্তাহে জনপ্রতি ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কৃষি পর্যটনের মাধ্যমে আয় করেন তাহলে এক সপ্তাহে আয় দাঁড়ায় চার হাজার কোটি টাকা, মাসিক আয় ষোল হাজার কোটি টাকা বছরে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এটা ধরা হয়েছে কৃষকের আয়, পরিবহন ও অন্যান্য বিবিধ আয়ের হিসাব করলে সেটিও এর দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে, আমাদের এই খাত থেকে আয়ের উৎস বের করতে হলে উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থাসহ গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা দরকার।’
বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক পর্যটন একটি নতুন ধারণা মনে হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে আরও আগে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইউক্রেন, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, পর্তুগাল, নেপাল, জ্যামাইকা, উগান্ডা, আয়ারল্যান্ড, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো। যেমন প্রাচীন মিশরে নীল নদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা কৃষি সভ্যতা এখন বৈশ্বিক পর্যটনের এক অনন্য নিদর্শন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন বৈশ্বিক কৃষি পর্যটনে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। ফ্রান্সের প্যারিস থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লাকুলুয়ে দো সারজি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে এক খামার। সেখানে বিভিন্ন রকমের শাক-সবজি, ফল-মূল, ফুল ও ফসল উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত সব ফসল শহরে বিক্রি করেন স্থানীয় অভিবাসীরা। শহর থেকে অনেক পর্যটকও এখানে আসেন। খামারটি মূলত কৃষিভিত্তিক পর্যটনের ধারণা মাথায় রেখে গড়ে তোলা হয়। এখানে পর্যটকরা ভ্রমণ করেন ইচ্ছামতো, নিজের পছন্দের ফলটি খেতে পারেন, আবার প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রয় করতে পারেন। কৃষি যে কতটা মুগ্ধকর হতে পারে, সে খামারে গিয়ে উপলব্ধি করা যায়। সেখানে আরও রয়েছে রেস্তোরাঁ, বাজার, দোকানপাট ইত্যাদি। খামারটিতে রয়েছে শিক্ষার্থীদের সহজলভ্য ভ্রমণের সুযোগ এবং প্রকৃতির খোলা দরজা, যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা কৃষি সম্পর্কে জানতে পারে এবং কৃষির জ্ঞানে নিজেদের সমৃদ্ধ করে পর্যটন ও কৃষির সমন্বয়ে এক অভিনব অর্থনৈতিক উন্নয়নের আবির্ভাব ঘটাতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথার্থ পদক্ষেপ নিলে কৃষি পর্যটন বাংলাদেশেও গড়ে তোলা সম্ভব। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারের কৃষি বিনিয়োগের পাশাপাশি কৃষি পর্যটনে কৃষকদের সম্পৃক্ত করা যায়। এতে দেশের কয়েক হাজার গ্রাম পর্যটন বান্ধব হবে। ৮০ শতাংশ কৃষি পেশায় নিয়োজিত আমাদের বাংলাদেশে এর বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা সুফল ভোগ করা দূরে থাক, এর শুরুই করতে পারছি না। সরকার কৃষি পর্যটনের দিকে সুদৃষ্টি দিলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে এক নবধারা উন্মোচিত হবে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে এক নতুন মাত্রা।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ বলেন, ‘গ্রামের অর্থনীতি ভবিষ্যতে কৃষি পর্যটন দিয়ে চালিত হবে। ভবিষ্যৎ গ্রামীণ এলাকায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কৃষি পর্যটনের উপর নির্ভর করবে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে কৃষি আয়ের ক্ষতির ফলে যে শূন্যতা তৈরি করা হয়েছে গ্রামীণ জীবিকা বিকাশের মাধ্যমে তা পূরণ করতে পারে কৃষি পর্যটন। আর পর্যটনের বিষয় মাথায় রেখেই সারাদেশে আমরা কৃষি সম্প্রসারণ করছি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনের দপ্তরগুলো সারাদেশে যে খামার গড়ে তুলছে তা একেকটি পর্যটন কেন্দ্র। কৃষি প্রতি মানুষের প্রচুর আগ্রহ। কৃষির প্রতি মানুষকে আরও আগ্রহী করে তুলতে বাংলাদেশে কৃষি পর্যটনের বিকাশ দরকার। কৃষি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করবে।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘কৃষি পর্যটনের বিকাশে ইতোমধ্যে একটি গাইড লাইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সম্ভাবনাময় কৃষিবিষয়ক পর্যটনের বিকাশে আমাদের নানা পরিকল্পনা আছে।’
- বিষয় :
- কৃষি
- কৃষিকাজ
- কৃষিমন্ত্রী
- পর্যটন