ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক

আশা-শঙ্কা দুইই আছে ডোনাল্ড লুর সফরে

সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে বাংলাদেশকেও

আশা-শঙ্কা দুইই আছে ডোনাল্ড লুর সফরে

.

 তাসনিম মহসিন

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪ | ০১:১৭ | আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ | ০৭:০৪

আস্থা স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আবারও এগিয়ে নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর সফরে এমন বার্তাই ঢাকাকে দিয়েছে ওয়াশিংটন। সেই সঙ্গে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে জানিয়েছেন দেশটির প্রত্যাশার কথা। ফলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন প্রত্যাশা সামনে রেখে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকেও। একই সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে অস্থিরতার শঙ্কাও।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু দেখতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে নির্বাচনটি ভালো হয়নি। তার পরও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে সামনের দিকে তাকানোর কথা বলেছে ওয়াশিংটন। তবে কি দুই দেশের সম্পর্কে আস্থার সংকট তৈরি হওয়ার পেছনের বিষয়গুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে– এমন প্রশ্নই উঠছে সাধারণের মনে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার মার্কিন রাজনীতির উল্লেখযোগ্য মূল্যবোধ। এ দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে দেশটি রাজনীতি ও বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। ফলে এ দুটি বিষয় উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে, তা ভাবার কোনো কারণ দেখেন না বিশ্লেষকরা। বরং সম্পর্কও এগিয়ে যাবে, একই সঙ্গে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উদ্বেগগুলোর সংস্কারও হবে– ডোনাল্ড লুর সফর থেকে এমন বার্তাই পেয়েছেন তারা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত বুধবার বৈঠকের পর ডোনাল্ড লু বলেন, বাংলাদেশ সফরে এসে দুই দেশের জনগণের মাঝে ফের আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করছি। আমরা জানি, গত বছর বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অনেক অস্থিরতা ছিল। আমরা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। এতে কিছু মতানৈক্য তৈরি হয়েছিল। সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক। এখন আমরা সামনে তাকাতে চাই, পেছনে নয়। আমরা সম্পর্ক জোরদারের উপায় খুঁজে বের করতে চাই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পর এ মার্কিন প্রতিনিধি আরও বলেন, আমাদের সম্পর্কের পথে অনেক কঠিন বিষয় রয়েছে– র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন। এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হলে ইতিবাচক সহযোগিতার ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে হবে।

এ নিয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার বিষয়ে পরিষ্কার বার্তা রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সম্পর্কের উদ্বেগগুলো নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা। আর উদ্বেগগুলো টেকসইভাবে দূর করার কার্যকর চেষ্টা ঢাকার পক্ষ থেকে করা না হলে সম্পর্কে অস্থিরতা আবারও দেখা দিতে পারে।

সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপরও রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এ আস্থার সংকট কাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ দূর করতে উদ্যোগী হতে হবে বাংলাদেশকে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তার আগের অবস্থান বজায় রেখেছে, যা সফরে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন ডোনাল্ড লু। ওয়াশিংটনের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। ফলে সংকটের টেকসই সমাধান না হলে আবারও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। ফলে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের টেকসই সমাধানে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ঢাকার সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে ‘অনেক অস্থিরতা’ তৈরি হয়েছিল, যা উল্লেখ করেছেন ডোনাল্ড লু। নির্বাচন-পরবর্তী দমনমূলক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাছে। বিশ্লেষকদের মতে, সম্পর্ক থেমে থাকার জিনিস নয়। এতে উত্থান-পতন থাকবে। তবে দেখতে হবে, বন্ধুরাষ্ট্রের যৌক্তিক উদ্বেগগুলো দূর করার ক্ষেত্রে আরেক বন্ধুরাষ্ট্র কতটা আন্তরিক। সেই আন্তরিকতাই সম্পর্ক উন্নয়নের গতি নির্ধারণ করবে।

গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করেছিল দেশটি। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া হবে না।

তবে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসে সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিলেন লু।

মার্কিন কর্মকর্তার এ সফরটি ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন ডোনাল্ড লু। ফলে এর থেকে বোঝা যায় যে, দুই দেশের সম্পর্ক শুধু সংকীর্ণ কিছু বিষয়ের ওপর সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং কৌশলগতসহ এতে একাধিক বিষয় রয়েছে। এ জন্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে উভয় দেশের জন্য একটি জয় সূচক স্থানে নেওয়ার উদ্যোগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করতে হবে। দুর্নীতি দমন, আর্থিক খাতে আরও সুশাসন নিশ্চিত করা, শ্রম খাতে স্থিতিশীলতা এবং জবাবদিহির মতো বিষয়গুলো নিয়মিত উদ্বেগের বিষয়। ফলে দুই দেশই সামনের দিনগুলোতে দ্বিপক্ষীয় এসব অভিন্ন উদ্বেগ সমাধানে কাজ করতে পারে।

আরও পড়ুন

×